বিশেষ প্রতিনিধি, নড়াইল নিউজ ২৪.কম
নড়াইলে মনবাসনা পুরনে তিনশ বছরের ঐতিহ্যবাহী মাসব্যাপী নিশিনাথ তলার বৈশাখী পূজা শেষ হচ্ছে আজ। মনবাসনা পুরনের জন্য প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রতি শনি-মঙ্গলবার নিশিনাথ তলায় চলে পূজা-অর্চনা। শ্রী শ্রী নিশিনাথ তলা মন্দির কমিটির আয়োজনে চলছে সপ্তাহব্যাপী মহানামযজ্ঞ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নড়াইল শহর থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে একটি বটগাছ (বাবা নিশিনাথের বটগাছ) কে কেন্দ্র করে নাম করন করা হয় নিশিনাথতলা। এই বটতলায় পূজারীদের ভীড়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই মেলার নামকরন হয়েছে ‘নিশিনাথ তলার বৈশাখী পূজা’। তবে এই বটগাছ ও নিশিনাথের মন্দিরে পূজা অর্চনা শুরু হয় তারও অনেক আগে থেকে। এর সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, ‘নিশিনাথ’ সনাতন ধর্মের একজন প্রতিষ্ঠিত দেবতা। নিশিনাথের আরেক নাম শিব। এই দেবতার পূজা ও ধ্যানের কথা পুরাতন সনাতন শাস্ত্র গ্রন্থে পাওয়া যায়।
জনশ্রুতি রয়েছে, অনেকেই এই দেবতা (বাবা নিশিনাথ) কে গভীর রাতে ঐ গাছ থেকে নেমে খড়ম পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পার্শ্ববর্তী চিত্রা নদীর বাঁধা ঘাটে স্নান করতে দেখেছেন। শুরুতে নিশিনাথতলার এই স্থানটি ইংরেজ আমলের জমিদারদের দখলে ছিল। এই স্থানের অলৌকিকত্ব অনুভব করে জমিদাররা প্রায় তিনশত বছর আগে নিশিনাথ ঠাকুরের নামে নড়াইল-নোয়াপাড়া সড়কের পাশে ওই বটগাছ তলায় একটি মন্দির তৈরি করে দেন। বিশাল এই বটগাছে দেবতা ‘নিশিনাথ ঠাকুর’ বসবাস করেন বলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আজও বিশ্বাস করেন।
সনাতন ধর্মাবলম্বী পূজারীরা নিজের মনবাসনা পূর্ণ করার জন্য নারী-পুরুষ সকলেই জল, দুধ, তেল, সিদুর দিয়ে পূজা করে থাকেন। অনেকে মনবাসনা পূরনের লক্ষে গাছের ডালে ছোট বড় ইট বেঁধে রেখে যেত এক সময়। মনবাসনা পূর্ণ হলে তারা ফিরে এসে সে ইট খুলে দেবতা নিশিনাথ ঠাকুরের নামে মন্দিরে সাধ্যমত পূজা দিয়ে যেত। তবে বর্তমানে গাছটির তেমন ডাল-পালা না থাকায় ইটের টুকরা বাঁধা তেমন দেখা যায়না, তবে ভক্তরা পূজা-অর্চনা করে থাকে।
ছবি: নড়াইল নিউজ ২৪.কম
জানাগেছে, নড়াইলবাসীর কাছে বৈশাখ মানেই নিশিনাথতলায় এসে চিত্রানদীর বাঁধাঘাট থেকে খালি পায়ে জল এসে ঢালা। পক-পবিত্র হয়ে দুধ-ফুল, তৈল দিয়ে পূজা করা, প্রসাদ বিতরন করা হয়ে থাকে। এই উৎসব মুখরতার অন্যতম একটি বড় অংশ হচ্ছে বৈশাখ মাস। আর বৈশাখ মানে নড়াইলবাসীর কাছে এক অন্যরকম একটি মাস। তেমনি এটি নড়াইলের ‘নিশিনাথ’ তলার বৈশাখী পূজা। এখানে বৈশাখ মাসের শনি-মঙ্গলবার তিনশ বছরের অধিক সময় ধরে পূজা অর্চনা হয়ে আসছে। দেশের মেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন মেলা নিশিনাথ তলার বৈশাখী মেলা। এ মেলা ধর্মীয় বিষয়ভিত্তিক হলেও ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসত প্রতিবছর এখানে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এ মেলার অসম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট ক্ষুণ্ন হয়নি কখনও। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিশিনাথ ঠাকুরের ভক্তরা আসেন তাকে স্মরণ করার জন্য। তবে এখন আর মেলা বসেনা তবে, চলে বাসব্যাপী পূজা।
বাবা নিশিনাথের ভক্ত শুক্লা সাহা নড়াইল নিউজ ২৪.কমকে বলেন, নিশিনাথতলায় আমরা ছোটবেলা থেকেই প্রতি বছরের বৈশাখ মাসের শনি-মঙ্গলবার এখানে পূজা করে থাকি। আমাদের মনবাসনা পুরনরেন জন্য পূজা করে থাকি।
সুজিত সাহা নামে এক পূজারী নড়াইল নিউজ ২৪.কমকে বলেন, আমাদের বিশ্বাস নিশিনাথতলায় বাবার কাছে কোন কিছু চাইলে তিনি তার মনের আশা পূরন করেন। মনের আশা পূরন হলে ভক্তরা এসে তাদের মানত পূজা-অর্চনা করে থাকেন।
অনিতা বিশ্বাস নড়াইল নিউজ ২৪.কমকে বলেন, কয়েক বছর আগেও নিশিনাথতলায় অনেক বড় মেলা বসত। সেখানে দেশের বিভিন্নস্থান থেকে দোকানীরা আসত তাদের পসরা নিয়ে। বৈশাখ মাস জুড়ে চলত সার্কাস, পুতুলনাচসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এখন তেমন কিছুই হয়না। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে এখানে পূজা-অর্চনা আর শেষের দিকে নামযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়।
নড়াইল নিশিনাথতলা পূজা মণ্ডপের পুরোহিত সুনিল চক্রবর্ত্তি নড়াইল নিউজ ২৪.কমকে বলেন, কত বছর যাবৎ নিশিনাথতলায় এখানে বৈশাখ মাসের প্রতি সপ্তাহের শনি-মঙ্গলবার গাছে জল ঢালা, পূজা-অর্চনা হয়ে আসছে তার সঠিক তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে আমরা শুনছি তিনশ বছরের কম নয়।
তিনি আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা শুধু নয়, বিভিন্ন দেশ থেকেও এখানে বাবা নিশিনাথের পূজা দিতে আসেন।
নড়াইল নিশিনাথতলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট অচিন চক্রবর্ত্তি নড়াইল নিউজ ২৪.কমকে বলেন, তিনশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে বৈশাখ মাসের প্রতি সপ্তাহের শনি-মঙ্গলবার নদী থেকে জল এনে গাছে ঢালা, পূজা-অর্চনা করে থাকে ভক্তরা।
পূজারী ও ভক্তদের বিশ্বাস বাবা নিশিনাথতলায় এসে কিছু চাইলে তাকে ফিরিয়ে দেন না। তাই সব সময় ভক্তরা আসলেও বৈশাখ মাসের শনি-মঙ্গলবার বেশি আসেন। তিনি আরও বলে, উৎসব মুখর পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বৈশাখ মাসের শেষ সপ্তাহব্যাপী নামযজ্ঞর মধ্যদিয়ে শেষ হচ্ছে নিশিনাথতলার পূজা।