১১জুন ১৯৮৫ দিনটি আমার পরিবার ও আমাদের জন্য অনেক বেদনাদায়ক ১১জুন ১৯৮৫ দিনটি আমার পরিবার ও আমাদের জন্য অনেক বেদনাদায়ক – Narail news 24.com
রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৩২ অপরাহ্ন

১১জুন ১৯৮৫ দিনটি আমার পরিবার ও আমাদের জন্য অনেক বেদনাদায়ক

Reporter Name
  • Update Time : শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১
ছবি সংগৃহীত

পূর্ব দিগন্তে তখনও সূর্য উঠেনি। আযানের ধ্বনি কানে ভেসে আসছে। আপনজন সবাই তখনও ঘুমিয়ে। আর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ৮ ও ৯নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা রক্তাক্ত সন্তানকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছেন নবগঙ্গার বালুচরে। ১১ই জুন বাবা ও বড় ভাইয়ের ৩৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী। বিএম কবিরুল হক মুক্তি, সংসদ সদস্য, নড়াইল-১,এর ফেসবুক থেকে নেওয়া। নড়াইল নিউজ ২৪.কম এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:-
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, তিনি যশোরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিজয় মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বয়রা যুদ্ধ ক্যাম্পে ব্যাংকারে দীর্ঘ পাঁচটি মাস তিনি রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নিজের ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন,”সীমানা স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালাম আজন্ম লালিত আমার প্রান প্রিয় জন্মভূমির দিকে। শেষ বিদায় গ্রহণকালে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রুধারা।জন্মভূমিকে সন্মোধন করে বললাম, মাগো আজন্মকাল তোঁকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেও জালেমের আইনে আজ আমরা দেশদ্রোহী। তোঁর দেওয়া আলো বাতাস, তোঁর দেওয়া ফল-শস্যে আজ আমাদের কোনো অধিকার নেই। তাই তোঁর পায়ের শৃঙ্খল মোচন করতে আজ তোঁকে ছেড়ে যাচ্ছি, নিয়ে নিলাম তোর বুকের এক টুকরো মাটি। যদি কোনো দিন তোর পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গতে পারি, তবেই ফিরে আসব তোর কোলে , অন্যথায় ভারতের মাটিতেই রচিত হবে আমার শেষ শয্যা। মাতৃভূমির কাছে এই প্রতিজ্ঞা করে ‘ জয় বাংলা’ বলে বঙ্গজননীর নিকট থেকে শেষ বিদায় গ্রহণ করে ভারতের মাটিতে পদার্পণ করলাম”…..
এখলাছ উদ্দিন বঙ্গজননীর শৃঙ্খল মোচন করে, পাকহানাদারদের পরাজিত করে বীরের বেঁশে পদার্পণ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে এবং প্রথম বিজয় মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য জাতির, মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যার মাধ্যমে আবারও ফিরে আসে সেই স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত প্রতিবিপ্লবী শক্তি। হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। হত্যা করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফকে এবং হত্যা করা হয় ৮ নং সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর খন্দকার নাজমুল হুদাকে। সামরিক ব্যাক্তিত্ব নাজমুল হুদার পাশের ব্যাংকারে থাকতেন ৮ ও ৯নং সেক্টরের বেসামরিক রাজনৈতিক উপদেষ্টা এখলাছ উদ্দিন আহমেদ। খন্দকার নাজমুল হুদার সাথে তিনিও অংশ গ্রহণ করতেন বিভিন্ন সামরিক যুদ্ধে। এখলাছ উদ্দিন আহমেদ ডায়েরিতে লিখেছেন , ” ৮ নং সেক্টরের অধীন বয়রা যুদ্ধ শিবিরে আমাকে নিয়োগ করা হয়। সেক্টর লিয়াজো অফিসার জনাব রওশন আলী ও সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর অনুরোধে ২৫শে আগস্ট বয়রা যুদ্ধ শিবিরে যোগদান করি। ৮ নং অধীন বয়রা যুদ্ধ শিবিরটি ছিল পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীর ঘাঁটির মাত্র কয়েকশ গজের মধ্যে অবস্থিত এবং এই যুদ্ধ শিবিরটির নিরাপত্তা যখন তখন বিঘ্নিত হতো। এই শিবিরকে লক্ষ্য করে আচমকা বেপরোয়াভাবে কামানের সেল নিক্ষেপ করা হতো। কোনো বেসামরিক লোক এই যুদ্ধংদেহি পরিস্থিতির মধ্যে এসে ঝুঁকি নিতে চাইতেন না। রাজনৈতিক উপদেষ্টার পদটি ছিলো চার জন তৎকালীন এম.পি.এ সাহেবদের জন্য সংরক্ষিত। যশোরের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে শিবির, তার নাম ছিলো জি-৪ আলফা কোং এবং ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরের নাম ছিলো জি-৪ব্রেভো কোং। জি-৪ আলফা কোম্পানিতে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছিলেন যশোরের জনাব তবিবুর রহমান সরদার এম পি.এ এবং জনাব শহীদ আলী খান এম.পি.এ। জি-৪ ব্রেভো কোম্পানিতে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছিলেন ফরিদপুরের সৈয়দ হায়দার হোসেন এম.পি.এ এবং জনাব মোশাররফ হোসেন এম.পি.এ। নিয়োগ পত্র দিয়ে বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও কেউই তাদের স্বকাজে যোগদান করেন নাই। শেষে আহ্বান এলো আমার কাছে। বয়রা যুদ্ধ শিবিরে রাজনৈতিক প্রশিক্ষকের দায়িত্ব আমি হাসিমুখে গ্রহণ করলাম। যেদিন জন্মভূমির নিকট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম, সেই দিনই আমার জীবনকে মনে মনে উৎসর্গ করেছিলাম স্বাধীনতার বেদীমূলে। যতবড় কঠিন দায়িত্ব হোক না কেন আমি প্রস্তুত, আমার সংকল্প হয় স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু। বঙ্গজননীর শৃঙ্খল মোচন করতে আমার সামান্য ক্ষমতার আওতায় এমন কোন ত্যাগ নেই যেটা আমি স্বীকার করতে রাজি নই, নিজের প্রাণতো সেখানে তুচ্ছ। যুদ্ধ শিবিরে আমার দায়িত্ব ছিল প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জোয়ানদের Politically motivated করা। জোয়ানদের Induction করা। দশ জন করে গ্রুপ তৈরি করে তাদের ভিতর থেকে কমান্ডার, ডেপুটি কমান্ডার ও প্লাটুন কমান্ডার নির্বাচিত করা। তাদের সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়া, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান দেওয়া এবং সর্বোপরি শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের মরণপন যুদ্ধে উদ্ভূদ্ধ করা।
দীর্ঘ পাঁচ মাস মেজর খন্দকার নাজমুল হুদা কতৃক অস্ত্র হাতে দিয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সমাপ্তির পর আমি ‘ জয় বাংলা’ ধ্বনি সহকারে তাদের বিদায় জানাতাম।”….
৭ই নভেম্বর খালেদ মোশারফের সাথেই নিহত হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ৮ নং সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর খন্দকার নাজমুল হুদা।
এখলাছ উদ্দীন আরো দশটি বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তার সে জীবনটা ছিলো স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিবিপ্লবী শক্তি রাজাকারদের বিরুদ্ধে এক সংগ্রামী জীবন। একাই তিনি এই অপশক্তির বিরুদ্ধে করেছিলেন জীবন্মৃত সংগ্রাম। তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন নিজের সুখের জন্য নয়, এসেছিলেন সুখের জীবন বিসর্জন দিয়ে, দেশকে বহিঃশক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে। সে যুদ্ধে এখলাছ উদ্দিন জয়ী হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাকে সোনার বাংলায় রুপান্তর করতে। তিনি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে, কারিগরি বিজ্ঞান -প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশকে শোষনমুক্ত সোনার বাংলায় পরিণত করতে। এখানে পারেননি তিনি জয়ী হতে। কিন্তু মাথা নত করেননি। সংগ্রাম করেছেন রাজনীতির জন্য অপশক্তির বিরুদ্ধে। তার সে সংগ্রাম ছিলো মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম। আপোষ তিনি করেননি। তিনি জানতেন প্রতিবিপ্লবী শক্তির সাথে এ সংগ্রামে তিনি বড়ই নিঃসঙ্গ। কখনো পিছু হটেননি, শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়েছেন। স্বপুত্র মৃত্যকে আলিঙ্গন করেছেন।
এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান ।
বিনম্র শ্রদ্ধা বাবা, তুমি আমাদের গর্ব !!!

লেখক পরিচিতি

বিএম কবিরুল হক মুক্তি

সংসদ সদস্য, নড়াইল-১

এর ফেসবুক থেকে নেওয়া

© এই নিউজ পোর্টালের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

ফেসবুকে শেয়ার করুন

More News Of This Category
পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
Developed by: A TO Z IT HOST
Tuhin
x