নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
গ্যাসের ঘাটতির কারণে সারা দেশের বাসাবাড়িতে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস-সংযোগ বন্ধ রয়েছে কয়েক বছর। বিকল্প হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহারের ওপর। নগরিকদের এলপিজি ব্যবহার নিশ্চিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রথমবারের মতো তরলীকৃত এই গ্যাসের মূল্য বেঁধে দিয়ে একটি আদেশ জারি করে গত ১২ এপ্রিল।
এরপর তিন দফায় এলপিজির দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ এই জুন মাসে এলপিজির মূল্যতালিকা প্রকাশ করে আদেশ জারি করেছে বিইআরসি। সরকারের এই মূল্যতালিকা অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজির এলপিজির এক সিলিন্ডারের দাম ৮৪২ টাকা।
জানা গেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। যে যার সুবিধামতো দামে বিক্রি করছেন এলপিজির সিলিন্ডার। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। তারা বলছেন, এলপিজির দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও যদি বেশি দামে কেনা লাগে, তা হলে শুধু শুধু দাম বেঁধে দেয়ার কোনো মানে হয় না। এটা জনগণের সঙ্গে একধরনের প্রতারণা।
সাধারণ মানুষ বাসাবাড়িতে সাধারণত ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করেন। এই ১২ কেজি গ্যাস খুচরা ব্যবসায়ী, ডিলার ও কোম্পানি- কে কত দামে কেনাবেচা করছে, তা জানতে অনুসন্ধান চালিয়েছে। দেখা গেছে, সরকার এই গ্যাসের দাম ৮৪২ টাকা বেঁধে দিলেও কখনো কখনো আরও ২০০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। কোম্পানিভেদে প্রতি সিলিন্ডারের দাম পড়ছে ১০৫০-১১০০ টাকা। কোনো কোনো কোম্পানির ১২ কেজির এলপিজির সিলিন্ডার বাসায় আনতে লাগছে ১১৫০ টাকা, যা সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে ৩০৮ টাকা বেশি।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার কাদেরাবাদ হাউজিংয়ে থাকেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বুলবুল আহম্মেদ। তার বাসায় গ্যাসের সংযোগ থাকলেও মাঝে মাঝে গ্যাস আসে না। এ জন্য বাসায় ১২ কেজির এলপিজির একটি সিলিন্ডার রাখেন তিনি।
দামের কথা জানতে চাইতেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন বুলবুল আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘সরকার নাকি গ্যাসের দাম কমিয়েছে। কিন্তু আমরা তো আর কম দামে পাচ্ছি না। সেই আগের দামেই কিনতে হচ্ছে। ফোন দিলে ১২ কেজির সিলিন্ডার বাসায় এসে দিয়ে যায়, দাম রাখে ১১০০ টাকা।
‘সরকারি দামের কথা বললে তারা বলে, ১১০০ টাকার নিচে কোনোভাবেই দিতে পারবে না। পরে এলাকার অন্যান্য দোকানেও গ্যাসের দাম যাচাই করেছি। সবাই একই দাম বলে। তাই দেখলাম কিছু করার নেই।’
কোন দোকান থেকে গ্যাস কেনেন, জানতে চাই তিনি বলেন, পাশের কাঁটাসুর এলাকার আকিল এন্টারপ্রাইজ থেকে।
বুলবুল আহম্মেদের কথা অনুসারে যায় মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুর এলাকায় অবস্থিত আকিল এন্টারপ্রাইজে। সেই দোকানে প্রায় সব কোম্পানিরই এলপিজির সিলিন্ডার পাওয়া গেল। কথা হলো দোকানমালিক শেখ ফরিদের সঙ্গে।
কথার শুরুতেই তিনি বলেন, ‘ভাই, আমি জানি সরকারিভাবে ১২ কেজি গ্যাসের দাম ৮৪২ টাকা। কিন্তু আমারা বেচি হাজার টাকার ওপরে। কারণ আমরাই সরকারি দামে কিনতে পারি না। সেই দামে বেচব কীভাবে?’
এই খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা বেক্সিমকোর এলপি গ্যাস কিনি ৯২০ টাকায় আর বেচি ১১০০ টাকায়। বসুন্ধরার এলপি গ্যাস কিনি ৮৮০ টাকায়, বেচি ১০৫০ টাকা। বিএমের এলপি গ্যাস কিনি ৮৮০ টাকায়, বেচি ১০৫০ টাকা। ওমেরার এলপি গ্যাস কিনি ৯১০ টাকায়, বেচি ১০৫০ টাকা। আর বাসায় সিলিন্ডার দিয়ে আসলে আরও ৫০ টাকা নিই। এ হিসাবে কোনো কোনো কোম্পানির সিলিন্ডার পড়ে ১১৫০ টাকা।’
তিনি বলেন, ‘আমরাও চাই সরকারনির্ধারিত দামে গ্যাস বিক্রি করতে। কারণ পাবলিক আমাদের দোকানে এসে সরকারি দামে কিনতে চায়। ওই দামে না দিলে ঝামেলা করে, তর্ক-বিতর্ক করে। তারা বুঝতেই চায় না যে আমরাও সরকারি দামের চেয়ে বেশি দামে এলপি গ্যাস কিনে আনি।’
খুচরা ব্যবসায়ীরা ডিলারদের কাছে জিম্মি বলে অভিযোগ করেন এই দোকানদার।
শেখ ফরিদ বলেন, ‘আমরা তো আর লস করে বিক্রি করব না। আমরা সিলিন্ডার-প্রতি ১০০ টাকা লাভ করতে চাই। সরকার ১২ কেজির দর ধরেছে আমাদের ২৭ টাকা লাভসহ ৮৪২ টাকা। কিন্তু আমরা ডিলারদের কাছে সরকারি দামে কিনতে গেলে তারা মানে না। বলে আমাদের দামে নিলে নাও, না নিলে যাও।
‘পাইকারিতে এই দাম সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কোম্পানিভেদে ৩৮ থেকে ৭৮ টাকা বেশি দিতে হয়। এখন ব্যবসা করতে হলে এই দামেই কিনতে হবে, বেচতে হবে আরও বেশি দামে। না হলে দোকান বন্ধ করে দিতে হবে।’
কোন ডিলারের কাছ থেকে গ্যাস কেনেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদপুরের নামারবাজার এলাকার মোল্লা এন্টারপ্রাইজ থেকে গ্যাস কিনি।’
শেখ ফরিদের কথার সূত্র ধরে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছেই নামারবাজার এলাকায় অবস্থিত মোল্লা এন্টারপ্রাইজে। কথা হয় দোকানমালিক মো. আব্দুর রব মোল্লার সঙ্গে। দুটি কোম্পানির ডিলারশিপ আছে তার। এ ছাড়া অন্যান্য কোম্পানির সিলিন্ডারও পাওয়া যায় তার দোকানে।
১২ কেজির এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার কোম্পানির কাছে থেকে কত টাকায় কেনেন এবং কত টাকায় বিক্রি করেন- জানতে চাইলে গড়িমসি করতে থাকেন আব্দুর রব মোল্লা। প্রথমে সরকারি দামেই বিক্রির দাবি জানান তিনি।
নানা প্রশ্নের পর একটা পর্যায়ে এই ডিলার বলেন, ‘আসলে সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছে (৮৪২ টাকা), ওই দামে কোম্পানি থেকেই আমরা আনতে পারি না। তার থেকেও আমাদের ২০-৩০ টাকা বেশি দামে আনতে হয়। কখনো কখনো এর চেয়ে বেশি দামেও আনতে হয়। এখন আপনিই বলেন, জনগণকে আমরা সরকারি দামে গ্যাস দেব কীভাবে?’
মোল্লা এন্টারপ্রাইজের মালিক আব্দুর রব মোল্লা বলেন, ‘আমার দুটি এলপি গ্যাস কোম্পানির ডিলারশিপ আছে। অন্যান্য কোম্পানির গ্যাস আমরা অন্যভাবে নিয়ে আসি। আমাদেরও তো দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন দিয়ে চলতে হবে। আমরা যদি কম দামে গ্যাস পাই, তাহলে সরকারি দামে বেচতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আপনারা কোম্পানির কাছে যান, তাদের কাছে শোনেন গ্যাসের দাম বেশি রাখে কেন?’
শুধু মোহাম্মদপুর এলাকা নয়, রাজধানীর অন্যান্য এলাকার বেশ কয়েকজন ডিলার ও ভোক্তার সঙ্গে কথা বলেও এলপিজি সিলিন্ডারের দাম নিয়ে এমন নৈরাজ্যকর চিত্র পাওয়া গেছে।
ডিলার আব্দুর রব মোল্লার অভিযোগের সত্যতা জানতে বেশ কয়েকটি এলপি গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। একটি ছাড়া কোনো কোম্পানিরই দায়িত্বশীল কেউ এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।
বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অফ সেলস প্রকৌশলী জাকারিয়া জালাল বলেন, ‘এগুলা এখন সেনসিটিভ ইনফরমেশন। আমাদের আগামী ১৫ তারিখে একটা সংবাদ সম্মেলন আছে। আমরা সেখানেই আমাদের এলপি গ্যাসের দাম নিয়ে কথা বলব।
‘এখনই এটা নিয়ে রিপোর্ট করে বেশি বেনিফিট হবে না। ভালো হয় আপনি আমাদের ওই সংবাদ সম্মেলনে আসলে।’
ভোক্তা ও ডিলারদের এসব অভিযোগ এবং কোম্পানিগুলোর এমন অবস্থানের কারণ জানতে রোববার বলেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ আব্দুল জলিলের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এলপি গ্যাসের দাম নিয়ে আইনি প্রক্রিয়া নেয়ার জন্য দুটি মন্ত্রণালকে চিঠি দিয়েছি। তারা যেন ব্যবস্থা নেয়। তারা মোবাইল কোর্ট দিয়ে কিছু অভিযান শুরুও করেছে। আমাদের যে আইন আছে, সেখানে আদেশ লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
‘কিন্তু এই আইনি সুযোগটা ব্যবহার করার জন্য যে বিধিমালা দরকার, সেই বিধিমালা এখনো হয়নি। তারপরও আমরা জনগণ যাতে ন্যায্য দামে গ্যাস পায়, সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
বিইআরসির তদন্তেও ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দামে এলপিজির সিলিন্ডার বেচাকেনা হচ্ছে বলে স্বীকার করেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, ‘আমরা যত রিপোর্ট পেয়েছি, তাতে দেখা গেছে আমাদের ঘোষিত দামের চেয়ে ঢাকায় একটু বেশি দাম আছে। জেলা শহরে আমাদের দামের কাছাকাছিই আছে। কিন্তু দাম বেশি নেয়া নিয়ে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো ডিলারের কাছ থেকে কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিতাম।
‘এ ছাড়া আমরা সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারতাম যদি আমাদের কাছে কোম্পানিগুলোর ডিলারদের তালিকা থাকত। কম্পানিগুলো এখনো আমাদের কাছে তাদের ডিলারদের তালিকা দেয়নি।’