নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
দেশে মাহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমতে শুরু করেছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সংকেত পাওয়া যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার। সে অনুযায়ী প্রস্তুত থাকতে বলা হচ্ছে স্কুল-কলেজগুলোকে। তবে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর স্কুল খুললেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কি না, সে প্রশ্ন অনেকের।
দেশে করোনা শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। প্রাণঘাতী ভাইরাসটির বিস্তার রোধে ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় বাড়ানো হয় ছুটির মেয়াদ। সর্বশেষ ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, দেশে ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায়। সংস্থাটির ভাষ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যত বেশি সময় বন্ধ থাকবে, ততই বাড়বে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থী, বিশেষ করে শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শ্রেণিকক্ষগুলো পাঠদানের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। স্কুল-কলেজের কাঠামোগত পরিবর্তন সম্ভব হলেও শিক্ষার্থীদের মানসিক ও সময় দূরত্ব কীভাবে সমন্বয় করা হবে, সেটি নিয়ে চিন্তিত শিক্ষাবিদরাও।
ইউনিসেফ জানায়, করোনা মহামারি শুরুর আগে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিক্ষার্থীর স্কুল গড়ে ৭৯ দিন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। মহামারি শুরুর পর স্কুলগুলো বন্ধ ছিল প্রায় পুরো বছর।
স্কুলে আনা বড় চ্যালেঞ্জ:
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনাই একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। কেননা দীর্ঘদিন ধরে স্কুলগুলো বন্ধ। স্কুলে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে কি না এ বিষয়ে অভিভাবকদের আশ্বস্ত করা সহজ কাজ নয়। এ জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন অভিভাবকরা আশ্বস্ত হয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠায়।’
তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারির সময়ে অনেক অভিভাবকের আয় কমে গেছে। তাই অনেকের পক্ষে শিশুদের স্কুলে পাঠানো সম্ভব নাও হতে পারে। আবার অনেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। যারা গ্রামে থাকে, তাদের অনেকেই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে বা তাদের অভ্যাস বদলে গেছে। শিশুদের স্কুলে আনার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
করোনাভীতি কমেনি:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয় খুললেই সব শিক্ষার্থীকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। কারণ এর মধ্যে অনেকেই ঝরে পড়েছে, যা বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি আমার পরামর্শ, ঝরে পড়া শিশুদের ব্যুরো অফ নন-ফরমাল এডুকেশনের লার্নিং সেন্টারে নিয়ে আসা হোক। এতে ঝরে পড়ার হার কমবে।’
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু স্কুল তো বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে, অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে। তাই শিশুদের স্কুলমুখী করতে এ বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে হবে।’
তার মতে, আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হলো অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে চাইবেন না। কারণ করোনাভীতি এখনো সম্পূর্ণ দূর হয়নি।
প্রাথমিকের স্কুল খোলার বিষয়ে দিন ভাগ করে ক্লাস চালুর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, দিন অনুযায়ী নির্দিষ্ট ক্লাসের ব্যবস্থা করা উচিত। এতে স্কুলে ভিড় কম হবে; স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে।
স্বাভাবিক জীবনে আসতে সময় লাগবে:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক বলেন, ‘দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় আমাদের প্রাত্যহিক রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। বলা যায়, এ সময়ে আমাদের জীবনযাপনে বড় ধরনের পরির্বতন এসেছে।’ স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে আসা সহজ নয় বলে মনে করেন মেহজাবীন হক।
তিনি আরও বলেন, ‘দেড় বছর অনেক সময়, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। স্কুল বন্ধ থাকায় নিয়মিত রুটিন (যেমন: সকালে ঘুম থেকে ওঠা, স্কুলের পড়া শেষ করা, টিচারের সংস্পর্শে থাকা) থেকে তারা অনেক দিন থেকে বিছিন্ন। এগুলো আবার স্বাভাবিক জীবনযাপনে আনতে সময় লাগবে। এটা শিশুদের স্কুলমুখী করার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি।’
শিশুরা যাতে স্কুল খোলার পর হঠাৎ করে চাপে পড়ে না যায়, এ ক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মেহজাবীন।
তিনি বলেন, ‘শিশুদের উৎসাহ দিতে হবে। আর পড়াশোনা যেন আনন্দদায়ক হয়, সে বিষয়ে বিশেষ জোর দিতে হবে। আর প্রয়োজনে চাইল্ড সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।’