স্টাফ রিপোর্টার, লোহাগড়া, নড়াইল
নড়াইলের লোহাগড়ায় যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রথমবারের মতো দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যদিয়ে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র কাহিনীকার ও চিকিৎসক নীহাররঞ্জন গুপ্তের ১১৩তম জন্মবার্ষির্কী পালিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার মধ্যে ছিল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা। বিকালে নীহাররঞ্জন গুপ্তের জীবন ও কর্মের ওপর সেমিনার, নীহাররঞ্জন সড়ক উদ্বোধন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুরস্বার বিতরণ ও কবিগানের আসর।
ছবি: নড়াইল নিউজ ২৪.কম
বরেণ্য লেখকের জন্মবার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে ডা: নীহাররঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনায় এই প্রথম বারেরমতো জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ও ডা: নীহাররঞ্জন গুপ্ত ফাউন্ডেশন এবং নড়াইল জেলা সংস্কৃতি উন্নয়ন পরিষদের আয়োজনে দিনব্যাপি নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নড়াইলের জেলা প্রশাসক ও নীহাররঞ্জন গুপ্ত ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাউদান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শরীফ আশরাফুজ্জামান, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডীন জীবন কৃষ্ণ সাহা, নড়াইলের পুলিশ সুপার মোঃ মেহেদী হাসান, লোহাগড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফয়জুল হক রোম, লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জহুরুল হক, মেয়র সৈয়দ মসিয়ুর রহমান, চারণকবি রওশন আলী, ডা: নীহাররঞ্জন গুপ্ত ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব সুজন রহমান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডা: নীহাররঞ্জন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা এস এম আকরাম শাহীদ চুন্নু।
ছবি: নড়াইল নিউজ ২৪.কম
উল্লেখ্য, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল নীহাররঞ্জন গুপ্ত ১৯১১ সালের ৬ জুন কোলকাতা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সত্যরঞ্জন গুপ্ত, মায়ের নাম লবঙ্গলতা দেবী। তাঁর সহধর্মিণীর নাম কনক এবং তিনি চার কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। ডা: নীহা রঞ্জন গুপ্তপ্রায় দু’শতাধিক উপন্যাস রচনা করেন।
ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্ত চাকরিজীবী পিতার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকালে ১৯৩০ সালে তিনি কোন্ন নগর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই তিনি আইএসসি পাস করে কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারী পাশ করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর ডাক্তার হিসেবে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। চাকরি জীবনের বাধ্যবাধকতা তাঁর কাছে বিরক্তিকর মনে হওয়ায় তিনি এ চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ব্যক্তিগত ভাবে আবার ডাক্তারী পেশায় নিযুক্ত হন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কলকাতায় বিশেষ পরিচিত হয়ে ওঠেন।
নীহার রঞ্জন গুপ্তের শৈশব থেকে সাহিত্যে হাতে খঁড়ি হয়েছিল। ষোল বছর বয়সেই তাঁর প্রথম লেখা উপন্যাস ‘রাজকুমারী’ ছাপা হয়।
তাঁর লিখিত উপন্যাসের সংখ্যা দুইশতেরও অধিক। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস গুলির মধ্যে ‘মঙ্গলসূত্র’, ‘উর্বশী সন্ধ্যা’, ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘অজ্ঞাতবাস’, ‘অমৃত পাত্রখানি’, ‘ইস্কাবনের টেক্কা’, ‘অশান্ত ঘূর্ণি’, ‘মধুমতি থেকে ভাগীরতী’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘ঝড়’,‘অপারেশন’, ‘ধূসর গোধূলী’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘কালো ভ্রমর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘কালোহাত’, ‘ঘুম নেই’, ‘পদাবলী কীর্তন’, ‘লালু ভুলু’, ‘কলঙ্ককথা’, ‘হাসপাতাল’, ‘কাজল লতা ও কিশোর সাহিত্য সমগ্র উল্যেখযোগ্য।
পরিবারের সাথে ডাঃ নীহার রঞ্জন গুপ্ত। সংগৃহীত ছবি: নড়াইল নিউজ ২৪.কম
কালজয়ী লেখক নীহাররঞ্জনের চল্লিশের অধিক উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘লালুভুলু’, ‘হাসপাতাল’, ‘মেঘ কালো’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘নূপুর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘বাদশা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মায়ামৃগ’, ‘কাজললতা’, ‘কন্যাকুমারী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ প্রভৃতি। গোয়েন্দা কাহিনী ‘কিরীটি রায়’ তার অপূর্ব সৃষ্টি।
তাঁর এই চলচ্চিত্রায়িত উপন্যাসগুলি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগৎকে সু-সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘লালুভুলু’ পাঁচটি ভাষায় চিত্রায়িত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে উপন্যাসটি বাংলাদেশেও চিত্রায়িত হয় এবং দর্শককুলের প্রশংসা অর্জন করে। নীহাররঞ্জনের অনেক উপন্যাস থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছে। বিশেষ করে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘উল্কা’ দীর্ঘদিন ধরে থিয়েটারের দর্শকদের আকৃষ্ট করেছে।
চিকিৎসক হিসেবে অতি কর্মচঞ্চল জীবনযাপনের মধ্যেও নীহার রঞ্জন রেখে গেছেন অসংখ্য সাহিত্যধর্মী সৃষ্টি, যা আপন সত্তায় ভাস্বর হয়ে থাকবে চিরকাল। নীহার রঞ্জন গুপ্ত ১৯৮৬ সালের ২০ জানুয়ারী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রায় এক একর ৩০ শতক জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত ডা: নীহাররঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক বসতবাড়িকে যাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার।প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক নীহার রঞ্জন গুপ্ত ১৯৮৬ সালের ২০ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।