নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কই এখন সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায়। দীর্ঘ সময়ের জন্য জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার তিন থেকে চার ঘণ্টা পরেও জলাবদ্ধতা থাকে অনেক এলাকায়। এটি রাজধানী ঢাকার নিয়মিত চিত্র। বারবার আশ্বাসের কথা শোনা গেলেও এই ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি মিলছে না নগরবাসীর।
ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে বর্তমান সরকার গত দুই মেয়াদে দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। এই মোটা অংকের টাকার প্রকল্প ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাস্তবায়ন করলেও কার্যত এর কোনো সুফল পায়নি নগরবাসী। মূলত চার সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় না থাকায় একই কাজ করা হচ্ছে বারবার। প্রকল্প বাস্তবায়নে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ঘাটতি আর সমন্বয়ের অভাবেই ঢাকার জলবদ্ধতা আটকে আছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।
জলবদ্ধতা নিরসনে ২০০৯ সাল থেকে গত এক দশকে সরকারের চারটি সংস্থা মোট ১ হাজার ৯৯৬ কোটি খরচ করেছে। সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ না কারায় বিপুল অংকের এই টাকা নর্দমা নির্মাণ ও মেরামত, পাম্পস্টেশন খাল-বক্স কালভার্ট খনন ও পরিষ্কার করার মতো ছোটখাটো কাজে ব্যয় করা হয়েছে । ফলে সাময়িক অসুবিধা দূর হলেও রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে এই টাকা কোনো কাজে লাগেনি।
ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মিলে ড্রেন, নর্দমা নির্মাণ ও খাল পরিষ্কার করার কাজে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, সেই পরিমাণ সুফল মেলেনি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ১০ মিনিটে ১২০ মিটার ড্রেন পরিষ্কার করার জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে জেড অ্যান্ড সাকার মেশিন কিনলেও তাতে তেমন একটা লাভ হয়নি।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘সিটি করপোরেশন মূলত নতুন লাইন তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। যে ড্রেনগুলো আছে সেগুলোর কোথায় কোথায় ব্লক হয়েছে তা পরিষ্কার করার ব্যাপারে তারা মনোযোগী নয়। ফলে নতুন করে ব্যাপক অর্থ খরচ করা হলেও পুরো নেটওয়ার্কিং না হওয়ায় সুফল মিলছে না।’
রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে জলাবদ্ধতা বেশি উত্তর সিটিতে৷ এর মধ্যে কারওয়ান বাজার, মিরপুর, কালশী, শ্যামলী, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলখেতসহ বিভিন্ন এলাকা অন্যতম৷ ঢাকার বেগুনবাড়ি, পান্থপথের বিভিন্ন এলাকা, ধানমণ্ডি, কুড়িল, পুরান ঢাকার আলাউদ্দিন রোড, যাত্রাবাড়ী মোড়, জুরাইন, শহীদনগর, মধুবাগে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় অল্প বৃষ্টিতেই৷ অলি-গলি হাঁটু থেকে কোমড় পানিতে তলিয়ে যায়৷ পূর্ব জুরাইন থেকে ডিএনডি বাঁধ পর্যন্ত এলাকায় বছরের প্রায় প্রতিদিনই পানি জমে থাকে৷ এই এলাকাটি অন্যান্য এলাকার তুলনায় অনেক নিচু হওয়ায় আশপাশের এলাকাসহ বাসা বাড়ির স্যুয়ারেজের পানি জমে জলাদ্ধতা দেখা দেয়৷
গত বছর জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি কর্পোরেশন প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দু’টি অত্যাধুনিক ‘জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন’ কিনেছে৷ বলা হয়েছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারে৷ প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করতে সক্ষম৷ কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না৷
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার জলাবদ্ধতাপ্রবণ এসব এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য গত দুই বছরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো প্রায় হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। এ বছর সড়ক, ফুটপাত ও ড্রেন নির্মাণে ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরেছে ডিএসসিসি। এরই মধ্যে প্রায় সব টাকা খরচ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া ডিএনসিসি তাদের বার্ষিক বাজেটে এ খাতে প্রায় ২৭৮ কোটি বরাদ্দ রেখেছে। এরই মধ্যে প্রায় সব টাকা খরচ করেছে এই সংস্থা। গত অর্থবছরে ডিএনসিসি নর্দমা ও ড্রেন নির্মাণে আরো ১৭৫ কোটি টাকা খরচ করে বলে জানা যায়। এ ছাড়া ডিএসসিসি তাদের একটি মেগা প্রকল্পের এক হাজার ২০২ কোটি টাকা থেকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে কয়েক কোটি টাকা ড্রেন ও নর্দমা নির্মাণে ব্যয় করেছে। ঢাকা ওয়াসাও তাদের নিজস্ব ড্রেন পরিষ্কারের পেছনে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করেছে বলে জানা যায়। এর পরও বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
ঢাকা ওয়াসার একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওয়াসা প্রতিবছর গড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা খাল ও ড্রেন পরিষ্কারের পেছনে ব্যয় করে থাকে। গত দুই বছরে এ সংস্থা ১০ কোটি টাকার মতো ব্যয় করেছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ দরকার। সেটি মন্ত্রণালয়ে চাওয়া হলেও তা পাওয়া যায়নি। ফলে ওয়াসা কাজ করতে পারেনি। আর দুই সিটি করপোরেশন থেকে ড্রেন ও নর্দমা নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলেও এর সুফল মিলছে না। কারণ সংস্থা দুটির পরিকল্পনা আর ডিজাইনে ত্রুটি রয়েছে।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, শান্তিনগর এলাকার জলাবদ্ধতা কমাতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। কিন্তু সেখানেও এখন বৃষ্টি হলে পানি জমে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা শান্তিনগর এলাকায় পানি নিষ্কাশনে সব কাজ শেষ করেছি। এখন ওয়াসার টিটিপাড়া পাম্পের সক্ষমতা না বাড়ালে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না। তাই ওয়াসাকে আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দাপ্তরিকভাবে পত্র দিয়েছি। আর ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর এলাকার জলাবদ্ধতা রোধে হাতিরঝিল প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কাজ করছে।’
১৯৯৬ সালের পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন আইন অনুযায়ী, ঢাকা শহরের পানিনিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ফলে নিয়মিত নর্দমাগুলো সচল রাখা ও পরিষ্কার করার দায়িত্ব ওয়াসার। কিন্তু প্রতিবছর বর্ষা এলেই বরাদ্দ নেওয়ার কথা মনে পড়ে ওয়াসার।
বর্ষার আগে কেন বরাদ্দ চায় ওয়াসা, জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ‘যখন বর্ষা, তখনই তো নর্দমা পরিষ্কার করতে হবে। আগে করলে তো ড্রেন ভরে যাবে। তাই আমরা বর্ষার আগেই এ বরাদ্দ চেয়ে থাকি। এবার অবশ্য অতিরিক্ত বরাদ্দ পেয়েছি।’ তাকসিম এ খান আরও বলেন, ‘এবার জলাবদ্ধতা তেমন হবে না, আমরা যথেষ্ট প্রস্তুত রয়েছি।’
ওয়াসা সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবে ওয়াসা বলেছে, গত কয়েক বছর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কয়েক শ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইনের সংযোগ ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ লাইনে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রচুর বালু ও মাটি ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ লাইনে প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া কার্পেটিং ও পুনঃকার্পেটিং করার কারণে ম্যানহোলগুলো ঢেকে গেছে এবং ক্যাচপিটগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই বর্ষায় এসব ক্যাচপিট নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করতে চায় ওয়াসা। এ ছাড়া বেশির ভাগ খালের পাশে খননযন্ত্র পৌঁছানোর রাস্তা না থাকায় খাল খননের জন্য বুলডোজার প্রয়োজন। ময়লা অপসারণের জন্য পর্যাপ্ত ডাম্প ট্রাক না থাকায় ডাম্প ট্রাক সংগ্রহ জরুরি। ওয়াসার মতে, এ ছাড়া ১৬টি পাম্প সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বড় ধরনের মেরামত এ রক্ষণাবেক্ষণকাজ করা প্রয়োজন। এসব করতেই তাদের এত টাকার প্রয়োজন।
এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে আলাদা দায়িত্ব চান ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র। দু’জনেরই মন্তব্য, ঢাকা ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এই কাজে চরম ব্যর্থ হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বলেন, সিটি করপোরেশন তাদের আওতাভুক্ত এলাকায় পানি নিষ্কাশন, জলাধার সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে দায়বদ্ধ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড জলাধার সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পানি নিষ্কাশনসহ জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব নিজেদের আওতায় রেখেছে। আইন অনুযায়ী তারা আমাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করছে না। কিন্তু তারা সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনও করছে না। ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করছে বলেই বছরের পর বছর ঢাকায় জলাবদ্ধতা প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আইন অনুযায়ী দায়িত্ব আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হলে আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্ত করতে পারবো বলে আশা রাখি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সরকারী সেবাসংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহ আলম খান বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নই, জলাশয় ভরাট ও অবৈধ দখলদারিত্বই জলাবদ্ধতার বড় কারণ। পানি নিষ্কাশনের দুটি পথ আছে৷ এক. ভূ-গর্ভে পানি শোষণ করে নেয়া এবং দুই. খাল, বিল ও ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যাওয়া৷ ঢাকায় এই দুটি পথের একটিও কার্যকর নেই৷ এ কারণে জলাবদ্ধতা বাড়ছেই৷ এ থেকে উত্তরনে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ও থাকতে হবে।