নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
বাংলাদেশ রেলওয়ে রেলের ইঞ্জিন সংকট দূর করতে ২০১১ সালে ৭০টি মিটার গেজ ডিজেল ইঞ্জিন আনার উদ্যোগ নেয় । ২০১৭ সালের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো রেলসেবায় যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক দশকে আসেনি একটি ইঞ্জিনও; বরং এ সময় প্রকল্পের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য খরচে সরকারের ব্যায় সোয়া ৫ কোটি টাকা। চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করার কথা ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি হুন্দাই রোটেমের।
টাকা গচ্চা যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিআইসি) সভায়। রেলের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারের (ডিএন মজুমদার) সভাপতিত্বে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এ সভায় দরদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে খরচ হওয়া টাকা নেয়া যায় কি না, সে বিষয়েও আলোচনা হয়। একই সঙ্গে এ বিষয়ে দায় কার, তা নিরূপণের আলোচনা হয়।
দেশি অর্থায়নের বদলে কোনো বিদেশি উৎস থেকে নমনীয় ঋণের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত ছিল। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) শর্ত অনুযায়ী অর্থায়নের জন্য ২০১১ এবং ২০১৩ সালে দুই দফায় দরপত্র আহ্বান করা হলেও কোনো দরদাতা পাওয়া যায়নি। পরে টেন্ডার ডকুমেন্ট এবং টেকনিক্যাল স্পেশিফিকেশন হালনাগাদ করে ২০১৪ সালে তৃতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হলে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র প্রস্তাব দাখিল করে।
এতে স্পেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভোসল এস্পেনা সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানটি নাম পরিবর্তন ও কারিগরি বিবেচনায় পিছিয়ে পড়ে। ফলে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রোটেম কার্যাদেশ পায়।
হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালে করা চুক্তি অনুযায়ী সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় প্রকল্পের অর্থসংস্থানের কথা ছিল কোম্পানিটির, তবে গত চার বছরে তা করতে তারা ব্যর্থ হয়। শুধু তা-ই নয়, চুক্তিমূল্যের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি অর্থ দাবি করেছে এ কোম্পানি, যা মেনে নেয়নি বাংলাদেশ রেলওয়ে। এতে কোম্পানিটি তাদের চুক্তি বাতিল করে এবং ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত চায়।
হুন্দাইয়ের সঙ্গে ৭০টি ইঞ্জিন কেনার চুক্তিমূল্য ছিল ২৩ কোটি ৯৪ লাখ ৫৭ হাজার ডলার বা ২ হাজার ৩৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
মূল্যায়ন সভায় প্রকল্প পরিচালক জানান, গত বছরের ৩ আগস্ট ও ৮ সেপ্টেম্বর হুন্দাই চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের চুক্তিমূল্য ১৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করে, কিন্তু রেলওয়ে জানিয়েছে, এ প্রস্তাব গ্রহণ করা কোনোভাবে সম্ভব নয়।
তিনি জানান, নভেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির কাছে সহজ শর্তে নমনীয় ঋণের টাউনশিপ চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি এক মাসেও তা পাঠাতে ব্যর্থ হয়। ১ ও ১৩ ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি তাদের করা চুক্তি বাতিল চেয়ে এবং ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত চেয়ে দুই দফা চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়েকে। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি ঋণের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাই তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা যেতে পারে। একই সঙ্গে তাদের ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত দেয়াসহ অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।
সভায় প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, ব্যাংক গ্যারান্টি বাবদ হুন্দাই কোম্পানির ২ কোটি ৩৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৮৬ ডলার বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে জমা আছে।
এ সময় রেলের একজন উপসচিব জানতে চান, এ প্রকল্পে যেহেতু এরই মধ্যে সোয়া ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, তাই এই টাকা হুন্দাইকে জরিমানা করা যায় কি না, গেলে তা তাদের ব্যাংক গ্যারান্টি থেকে কেটে নেয়া যেতে পারে। তা না হলে এই পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের দায় কার, তা নিরূপণ করতে হবে।
তখন প্রকল্প পরিচালক জানান, হুন্দাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের চুক্তি হয় ২০১৮ সালে। এরপর থেকে চুক্তিটি অকার্যকর থাকায় চুক্তিমূল্যের কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে, তা বেতন-ভাতা, ট্রান্সপোর্টেশন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে।
ওই সময় রেলের মহাপরিচালক সভায় উপস্থিত অন্যদের মতামত চাইলে রেলের একজন যুগ্ম সচিব বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। এ ক্ষেত্রে অডিট আপত্তি হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মতামত নিতে হবে। এ প্রকল্পটির ওপর আইএমইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
চলতেই থাকবে প্রকল্পটি
এদিকে এক যুগেও প্রকল্পটির কোনো অগ্রগতি না থাকলেও এটি চলমান থাকবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরই মধ্যে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ইঞ্জিন কিনতে আবারও দরপত্র আহ্বান করতে চায় রেলওয়ে।
প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, এর আগে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। কোরিয়া সরকারের ইডিসিএফের ঋণ নিয়ে নতুন দরপত্র একই পদ্ধতিতে আহ্বান করা উচিত।
এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ইডিসিএফ থেকে ঋণ নিলে কোরিয়া ছাড়া অন্য অনেক দেশের কোম্পানি এতে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবে। তা ছাড়া কোরিয়া থেকে শুধু একটি কোম্পানি সবসময় দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। তাই অন্য উৎস থেকে ঋণ নেয়া যেতে পারে। সভায় উপস্থিত অধিকাংশ সদস্যই প্রকল্প পরিচালকের কথায় সম্মতি দেন।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ডি এন মজুমদারকে বেশ কয়েকবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।
হুন্দাইয়ের সঙ্গে অন্য প্রকল্পে চলছে ঝামেলা
অন্য একটি প্রকল্পে চুক্তি ভঙ্গ করে রেলের ১০টি ইঞ্জিনে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ সংযোজন করেছে হুন্দাই রোটেম। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি নিম্নমানের যন্ত্রাংশ সংযোজনের প্রমাণ পেয়েছে।
২০২০ সালের আগস্টে দেশে এলেও ইঞ্জিনগুলো ১৪ মাস গ্রহণ করা হয়নি। এ ১৪ মাসেও নিম্নমানের যন্ত্রাংশ বদলে দেয়নি হুন্দাই রোটেম। আবার হুন্দাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি।
এ অবস্থায় নিম্নমানের ইঞ্জিন নিয়েছে রেলওয়ে। গত ৪ অক্টোবর শর্তসাপেক্ষে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করা হয়। তবে প্রথম ট্রিপেই ফেল করে ৩০০৩ মডেলের একটি ইঞ্জিন। এটি চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়ে ঢাকার পথে তেজগাঁওয়ের কাছে বন্ধ হয়ে যায়।
হুন্দাই রোটেমের সরবরাহ করা ১০টি মিটার গেজ ইঞ্জিনকে যাতে ব্রড গেজে রূপান্তর করা যায়। সে জন্য সেগুলোতে টিএ১২ মডেলের অলটারনেটর সংযোজনের শর্ত ছিল। এগুলো তিন হাজার কেভিএ (কিলো ভোল্ট অ্যাম্পিয়ার) শক্তির, তবে চুক্তি ভঙ্গ করে ইঞ্জিনগুলোয় টিএ৯ মডেলের অলটারনেটর সংযোজন করে হুন্দাই রোটেম।
এগুলো দুই হাজার কেভিএর। ফলে পরবর্তীকালে ইঞ্জিনগুলো আর প্রয়োজনে ব্রডগেজে রূপান্তর করা যাবে না।
বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে ২৬৩টি লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৭৫টি বা ৬৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। ৭৮টি ৫০ বছরেরও বেশি পুরনো। এমনকি ১৯৫৩ সালে কেনা ৯টি লোকোমোটিভও বর্তমানে চালানো হচ্ছে।
একটি লোকোমোটিভের সেবার আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। ব্যয়বহুল মেরামত ও অধিক জ্বালানি ব্যয়ের মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ এসব ইঞ্জিন চলমান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অনেক পুরোনো মডেল হওয়ায় মেরামতের সময় প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশও এখন পাওয়া যাচ্ছে না।