নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
পুঁজিবাজার চাঙা হয়ে ওঠার কারনে ব্যাংকগুলো তাদের বিশেষ তহবিল থেকে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। শুরুর দিকে ব্যাংকগুলো শেয়ার কিনতে আগ্রহ কম দেখালেও বাজার স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিতে শুরু করলে তারাও শেয়ার কেনা বাড়িয়ে দেয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
২০২০ সালের শুরুতে পুঁজিবাজারে যখন মন্দাভাব, তখন বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়াতে প্রতিটি ব্যাংককে ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য তহবিল গঠনসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এই বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো নিজস্ব বিনিয়োগের বাইরে। ব্যাংকগুলো তার মোট দায় সম্পদের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ এমনিতেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। তার মধ্যে কত শতাংশ তারা বিনিয়োগ করেছে, সেই হিসাব অবশ্য পাওয়া যায়নি।
তবে বিশেষ তহবিল গঠন করে বিনিয়োগের যে সুযোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে, তাতে এটা বোঝা যায়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ব্যাংক অনেকটাই সতর্ক। প্রায় অর্ধেক ব্যাংক এই তহবিল গঠনই করেনি। আর বেশির ভাগ ব্যাংক যত টাকা দিতে পারত, দিয়েছে তার অর্ধেক বা তার চেয়ে কম। আবার যে তহবিল গঠন হয়েছে, তারও অর্ধেকের কম টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
তহবিল ও বিনিয়োগ বাড়ছে ধীরে ধীরে:
ব্যাংকগুলোর সব যদি এই পরিমাণ টাকা দিয়ে তহবিল গঠন করত, তাহলে ৬২ ব্যাংকের তহবিল হতে পারত ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু তহবিল এত বড় হয়নি।
৫ আগস্ট পর্যন্ত ৩৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক মিলে ৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে। একেকটি ব্যাংক গড়ে ১০০ কোটি টাকার কিছু বেশি দিয়েছে।
এর পুরোটা এখনও বিনিয়োগ করা হয়নি। এর মধ্যে শেয়ার কেনা হয়েছে ১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকার। হাতে আছে এখনও ১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ব্যাংকগুলোতে যে পরিমাণের তহবিল গঠন হয়েছে, তার ৪৭ শতাংশ বিনিয়োগে এসেছে। তবে এই তহবিল আর বিনিয়োগ বাজার চাঙা হতে হতে বাড়ছে।
গত মার্চ পর্যন্ত ২৬টি ব্যাংক ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করে। সে সময় বিনিয়োগ ছিল ১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এপ্রিল থেকে তহবিল বেড়েছে ৭৮৫ কোটি টাকা আর বিনিয়োগ বেড়েছে ৭০০ কোটি টাকা।
গত ২০ মে পর্যন্ত ২৭টি ব্যাংক প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে। এর মধ্যে বিনিয়োগ করেছিল ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত আড়াই মাসে এ তহবিল থেকে বিনিয়োগ ৩৩৭ কোটি টাকা বেড়েছে।
গত ৭ মাসের এই বিনিয়োগ থেকে ব্যাংকগুলো বেশ লাভবান হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কারণ মার্চ শেষে ১ এপ্রিল বাজারে সূচক ছিল ৫ হাজার ২৭০ পয়েন্ট। আর গত বৃহস্পতিবার বাজার শেষ হয়েছে ৬ হাজার ৭৭১ পয়েন্টে। অর্থাৎ বেড়েছে ১ হাজার ৫০ পয়েন্ট।
পুঁজিবাজার ইদানীং বেশ চাঙা হয়ে উঠছে। ২০১০ সালের মহাধসের পর থেকে টানা ১০ বছর ছিল অস্থিতিশীল। এর মধ্যে ব্যাংক যে বিনিয়োগ করেছে, বছর শেষে মুনাফা হয়েছে কমই। এ কারণে লোকসানের বিপরীতে তাদের সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়েছে।
তবে চাঙা বাজারের কারণে এবার মুনাফা যে বেশ ভালো হচ্ছে, তা ব্যাংকগুলোর অর্ধবার্ষিক প্রকাশিত হিসাবে স্পষ্ট।
ইদানীং পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি একটি সার্কুলার দিয়ে পুঁজিবাজার এবং অন্য খাতে ব্যাংক ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের তথ্য প্রতিদিন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ব্যাংকগুলো বলছে, প্রতিদিনের তথ্য দেয়া কঠিন। তারা দিতে চায় মাসের হিসাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এই পদক্ষেপ নিয়েছে এ কারণে যে করোনায় বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো হয়তো তাদের অলস অর্থ পুঁজিবাজারে নিয়ে আসবে। এতে অতিরিক্ত তারল্যের কারণে বুদ্বুদ তৈরি হলে পরে বাজারে ধস নামবে।
তবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সমিতি মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন মনে করে, পুঁজিবাজার কোনোভাবেই অতি মূল্যায়িত নয়, বরং অবমূল্যায়িত। প্রতিবেশী ভারতসহ উন্নয়নশীল আরও অনেক দেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে তুলনা করে তারা দেখিয়েছে, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের মূল্য আয় অনুপাত (শেয়ার মূল্যের সঙ্গে শেয়ার প্রতি আয়ের অনুপাত) কম।
বাংলাদেশে গড় অনুপাত ১৫-এর মতো। অর্থাৎ একেকটি শেয়ারের যে দাম, সেটির সমান আয় উঠে আসবে ১৫ বছরে। এই অনুপাত দেশের ব্যাংকিংব্যবস্থার সুদের গড় হারের চেয়ে অনেক বেশি। সুদহার এখন ৪ শতাংশের কিছুটা বেশি, যেটি টেনে বাড়াতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামও বিশ্বাস করেন, পুঁজিবাজার কোনোভাবেই অতি মূল্যায়িত নয়, বরং বাজার আরও অনেক দূর যাবে।
বিশেষ তহবিল নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বলছে:
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পরও সব ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার তহবিল না করার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আইন অনুযায়ী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য তারা কোনো ব্যাংককে বাধ্য করতে পারেন না। এ জন্য ব্যাংকগুলোর বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তারা। তবে পুঁজিবাজার ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। এ অবস্থা স্থায়ী হলে ব্যাংকগুলো নিজেরাই শেয়ার কিনবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি সাপোর্ট আছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারও রয়েছে। কোনো ব্যাংক আমাদের কাছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের অনুমতি চাইলে আমরা অনুমতি দিই। তবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতেই হবে, বিষয়টি এমন নয়।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সব পলিসি মেনেই তারা বিনিয়োগ করেছে এবং করতে পারে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো চাপ দেয়া হয়নি। ব্যাংকগুলোকে একটা সুবিধা দেয়া হয়েছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য। এটা ব্যাংক ইচ্ছামতো করতে পারবে।’
ব্যাংকাররা যা বলছেন:
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরফান আলী বলেন, যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান পুঁজিবাজার স্থিতিশীল। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুঁজিবাজারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ মুহূর্তে আর্থিক খাতের বেশির ভাগ অর্থ সরবরাহ করে ব্যাংক খাত। ব্যাংকনির্ভরতা কমাতে পুঁজিবাজার শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।‘
তবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগ শিক্ষা জরুরি জানিয়ে এই বিষয়টিতে জোর দেন তিনি। বলেন, ‘মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার একে অপরের পরিপূরক। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি আছে। তবে এসব ঝুঁকি নিয়েই বিনিয়োগ করতে হবে।’
ব্র্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘পুঁজিবাজার এখন চাঙা আছে। আগের তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালীও। ব্যাংকগুলোও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করেছে। ফলে শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত আছে।’
বিশেষ তহবিল কবে:
২০২০ সালের শুরুতে পুঁজিবাজারের টানা দরপতন সামাল দিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল ও বন্ড রেপোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করতে পারে। ব্যাংকগুলো চাইলে নিজস্ব উৎস থেকেও এমন তহবিল গঠন করতে পারে।
ওই বিশেষ তহবিলের সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নিজস্ব পোর্টফোলিওতে ব্যবহার করতে পারবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে গঠন করা বিশেষ তহবিল ২০২৫ সাল পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারবে ব্যাংক, যা পুঁজিবাজারে ব্যাংক কোম্পানি আইনের বর্ণিত বিনিয়োগ গণনার বাইরে থাকবে।
ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানির নিজস্ব নতুন পোর্টফোলিও গঠনের জন্য ঋণ হিসেবে তহবিলের ২০ শতাংশ দেয়া যাবে।
অন্য ব্যাংকের বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউসের নিজস্ব নতুন পোর্টফোলিওর জন্য ৩০ শতাংশ এবং অন্যান্য মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের নিজস্ব নতুন পোর্টফোলিও গঠনের জন্য তহবিলের ১০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দেয়া যাবে।
এই বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখতে কিছু শর্তও দেয়া হয়েছে। রুগণ ও ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনা ঠেকাতে কিছু বিধিনিষেধও আরোপ করা হয়েছে। যেসব কোম্পানির ৭০ শতাংশ ফ্লোটিং শেয়ার আছে এবং অন্তত তিন বছর ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিয়েছে তাদের শেয়ার কেনা যাবে।