নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
দিন দিন কমছে মহিষের উৎপাদন। ব্যতিক্রমী কিছু না ঘটলে সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন দেশের সুপরিচিত গবাদি পশু মহিষকে দেখতে যেতে হবে চিড়িয়াখানায় ! দেশে মহিষের অভ্যন্তরীণ প্রজনন বা উৎপাদন না বাড়ায় এমন আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, আশির দশকে দেশে মহিষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪২ লাখ। গত কয়েক দশকে এ সংখ্যাটি কোটিতে পরিণত হতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি হয়নি। বছর বছর এ সংখ্যা কমতে কমতে ২০১০ সাল নাগাদ নেমে আসে ১৪ লাখ ৮৩ হাজারে।
২০১৫ সালে দেশে মহিষের সংখ্যা আরও কমে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৩০ হাজার, ২০১৮ সালে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৮৩০টি। সবশেষ ২০১৯ সালের হিসাবে দেশে মহিষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৪১১টিতে।
তবে ২০১৯ সালের পর চলতি বছর পর্যন্ত দেশে দুটি কোরবানির উৎসব গেছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে প্রতিটি উৎসবেই গড়ে ১ লাখ মহিষ জবাই করা হয়েছে। এ ছাড়া মাংস ব্যবসায়ী সমিতির দাবি, মাংসের চাহিদার জন্য সারা দেশে প্রতিদিন কয়েক শ মহিষ জবাই করা হয়। কিন্তু মাংস সরবরাহের জন্য যে পরিমাণ মহিষ জবাই হয়, তার ঘাটতি পূরণে দেশে সে হারে মহিষের বংশবিস্তার বা নতুন মহিষের জন্ম হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত কয়েক দশকে দেশে যে সংখ্যক মহিষ জন্ম হয়েছে, জনসংখ্যা অনুপাতে মাংস উৎপাদনের প্রয়োজন মেটাতে তার থেকে কয়েক গুণ বেশি মহিষ নিধন হয়েছে।
দেশে মহিষের মাংস তত জনপ্রিয় নয়। গরুর চাহিদা ও দাম বাড়তে থাকায় এবং এর বিপরীতে তুলনামূলক মহিষের চাহিদা কম থাকার কারণে, দাম ক্রমাগত কমতে থাকায় বাজারে অনেক বিক্রেতা ভোক্তাকে ধোঁকা দিয়ে মহিষের মাংসকেই অবাধে গরুর মাংস বলে চালিয়ে দিত। এতে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে মহিষ।
মাংস খাওয়ার নামে নির্বিচার মহিষ নিধনই এ গবাদি পশুর বিলুপ্তির আশঙ্কার একমাত্র কারণ নয়। এর পাশাপাশি মহিষ রক্ষা, জাত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাব ছিল। জনসংখ্যার চাপে মহিষের চারণভূমি ক্রমাগত কমতে থাকায় বাসযোগ্য আবাসন এলাকার সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসা পদ্ধতির অভাব এবং নানা রোগ-বালাইয়ের কারণেও অনেক মহিষের মৃত্যু ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে উপকূলীয় অঞ্চলের চারণভূমি এলাকা ছাড়া ইতিমধ্যে অনেক এলাকা মহিষশূন্য হয়ে পড়েছে। এভাবে ধারাবাহিকভাবে কমে আসায় দেশ থেকে এখন গৃহপালিত মহিষ বিলুপ্তির পথে।
অথচ দেশে এ চিত্রটি পুরাই উল্টো হতে পারত। কেননা এই সময়ে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ প্রায় সব পশুপাখির খামার বেড়েছে।
গরুর চেয়ে মহিষ লাভজনক:
মহিষ পালনের গুরুত্বের বিষয়ে সম্প্রতি একটি প্রকাশনা বের করেছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত সোসাইটি ফর ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভস (এসডিআই) নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। এর নির্বাহী পরিচালক সামছুল হক দেশে মহিষ পালনের সম্ভাবনা বিষয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে দাবি করেন, গরুর তুলনায় মহিষ পালনে সুবিধা বেশি। কারণ এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। মৃত্যুর হার কম। মহিষ সহজেই নিম্নমানের খাবার খেয়ে হজম করতে পারে- এই দিয়েই সে দেহ বৃদ্ধি অক্ষুণ্ন রাখতে পারে। তাছাড়া গৃহপালিত হিসেবে এদের বাসস্থান কিংবা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্য যে কোনো প্রাণীর তুলনায় খুব কম ব্যয়বহুল।
এদের পরিচর্যা আরও সহজ। মহিষ গরুর তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশিসংখ্যক বাচ্চা জন্ম দেয় এবং তার থেকে বেশি মাংসও পাওয়া যায়। নানাবিধ দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের জন্যও মহিষের দুধ বেশি উপযোগী ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এ ক্ষেত্রে দুই কেজি গরুর দুধের সমান এক কেজি মহিষের দুধ।
সামছুল হক দাবি করেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও ভূ-প্রকৃতি মহিষ পালনের খুবই উপযোগী। ইতিমধ্যে গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশের সার্বিক আবহাওয়ায় লাভজনকভাবে মহিষ পালন সম্ভব। জনসংখ্যার চাপে বাংলাদেশের পশুর চারণভূমি কমে গেলেও উপকূলীয় বিরাণ চরাঞ্চল, যা মহিষের আদর্শ চারণভূমি হিসেবে খ্যাত, সেসব অঞ্চলে ব্যাপক আকারে কিছুটা আধুনিক পদ্ধতিতে মহিষের লাভজনক খামার গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশে মহিষ পালনের বিপুল সম্ভাবনার দিকটি এখন পর্যন্ত ব্যাপক সংখ্যক কৃষক, খামারি ও পরিকল্পনাবিদদের কাছে যথাযথ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়নি। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা শাখা) আফলাক উদ্দিন ফকির জানান, ‘মহিষের প্রতি দেশের মানুষের আগ্রহ কম। তা ছাড়া যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে মহিষের জাত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম সেভাবে বিস্তার লাভ করেনি। মানুষ এখন হাই-ইল্ডি ব্রিড পালনে আগ্রহী। মহিষের সে রকম জাত দেশে পাওয়া যায় না।’
আফলাক উদ্দিন দাবি করেন, সরকারিভাবে ইতিমধ্যে দেশে মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে উন্নত জাতের বীজ উৎপাদনের জন্য তিনটি মহিষের খামার স্থাপন, গাভি মহিষের কৃত্রিম প্রজনন, উন্নতমানের বীজ সংগ্রহের জন্য উন্নত জাতের মহিষের ষাঁড় পালন, হিমায়িত সিমেন তৈরির জন্য ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং মহিষের সংখ্যার অগ্রাধিকারভিত্তিক ১৩টি জেলার ৩৯টি উপজেলায় প্রকল্প এলাকা বিস্তারের মাধ্যমে সেখানে কৃষক ও খামারিদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে মহিষের জাত উন্নয়ন ও বংশ বিস্তার ঘটবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করছেন, সরকারিভাবে নেয়া এ প্রকল্পের আওতায় অল্পসংখ্যক মহিষ ও অল্পসংখ্যক কৃষক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে এর সুফল কতটা পাওয়া যাবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ এর আগে গরুর জাত উন্নয়নেও একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু তার কোনো সুফল দেশ পায়নি।
বিশ্বজুড়ে মহিষ:
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৭৪টি দেশে মহিষের বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মাংসের চাহিদার ৩০ শতাংশই জোগান দেয় মহিষ। এশিয়ার সব দেশে মহিষের উৎপাদন বেড়েছে। শুধু বাড়েনি বাংলাদেশে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে মোট মহিষের সংখ্যা ১৯ কোটি ৫০ লাখ ৯৮ হাজার ৩১৬টি, যার শতকরা ৯৭ দশমিক ০৯ ভাগ রয়েছে এশিয়া অঞ্চলে। এশিয়া অঞ্চলের মোট মহিষের ৭৭ দশমিক ৭০ ভাগ দক্ষিণ এশিয়ায়, ১২ দশমিক ১৯ ভাগ পূর্ব এশিয়ায়, ৬ দশমিক ৬৭ ভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, শূন্য দশমিক ৫ ভাগের কম পালন করা হয় মধ্য এবং পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে। তবে বিশ্বে বেশি মহিষ আছে এমন শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান প্রথম, যাদের মহিষের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। বাংলাদেশে সে সংখ্যা ৪ লাখের নিচে।
বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও মেঘনা নদীর অববাহিকা এবং উপকূল এলাকা বিশেষভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে মহিষের বিচরণ তুলনামূলক বেশি।
মহিষের মাংসে চর্বি কম:
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগসহ (ইউএসডিএ) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, মহিষের মাংসে কোলেস্টেরলের পরিমাণ মুরগির চেয়ে কম। এতে ক্যালোরি ও প্রয়োজনীয় চর্বিজাতীয় উপাদান গরুর মাংসের তুলনায় অনেক বেশি। প্রোটিনও তুলনামূলক বেশি। গরুর মাংসে চর্বির পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হলেও মহিষের মাংসে তা মাত্র ২ শতাংশ। অন্যদিকে গরুর তুলনায় মহিষের মাংস কম লাল হলেও মহিষের মাংসে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। উভয় মাংসের স্বাদও প্রায় একই রকম।
বিলুপ্তি ঠেকাতে মহিষ আমদানির চেষ্টা:
দেশে মহিষের জাত রক্ষায় বিদেশ থেকে মহিষ আমদানির ইচ্ছা পোষণ করেছে ‘সেভ অ্যান্ড সেফটি ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান।
এই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মেহেদি হোসেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গত সপ্তাহে একটি চিঠি দিয়ে দেশে মহিষের নানা সংকটের কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখার কথা জানিয়ে চিঠিতে ভারত থেকে ৫০ হাজার মহিষ আমদানির অনুমতি চেয়ে অনাপত্তিপত্র ইস্যুর আবেদন করেন তিনি।
আমদানি নীতি ২০১৫-১৮ অনুযায়ী দেশে মহিষ আমদানি নিষিদ্ধ নয়। তবে আমদানিতে বাধা না থাকলেও ভারত থেকে মহিষ আমদানি করতে গেলে ভারতীয় কাস্টম কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের অনাপত্তি চেয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেহেদি হোসেন বলেন, ‘একসময়ের গৃহপালিত মহিষ এখন কোনো গৃহে দেখতে পাবেন না। প্রতিদিনই কমছে মহিষের সংখ্যা। এটি এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে এসেছে। পাশাপাশি সময় এসেছে প্রাণীটির অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আগেই এ বিষয়ে সরকারের কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেয়ার।’
তিনি দাবি করেন, জরুরি ভিত্তিতে দুইভাবে মহিষের অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়। প্রথমত, মহিষের সংখ্যা দ্রুত বাড়াতে বাণিজ্যিক খামার পর্যায়ের কিছু প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত মহিষ আমদানির অনুমতি দেয়া। দ্বিতীয়ত, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিদেশ থেকে উন্নত প্রজাতির মহিষের বিপুলসংখ্যক হিমায়িত সিমেন আমদানি করে তা সংরক্ষণ এবং কৃষক ও খামারি পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, প্রতিবছর প্রতি উপজেলায় মহিষের চাহিদা রয়েছে ৪০ হাজার। মোট ৪৯২ উপজেলায় এ হিসাবে গড়ে ২ কোটি মহিষের প্রয়োজন।
তবে দেশে যে পরিমাণ মহিষ পালিত হয়, তা চাহিদার তুলনায় নগণ্য। মহিষের এ স্বল্পতার ফলে এটির চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। বাকি মহিষ যোগান দিতে গিয়ে খামারিরা বিভিন্নভাবে চোরাই পথে ভারত থেকে আসা মহিষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এ সমস্যা সমাধান না হলে মহিষ পালন হুমকির মুখে পড়বে।
চিঠিতে বলা হয়, মাংসের চাহিদা পূরণ করার জন্য ভারত থেকে মহিষের মাংস আমদানি করা হচ্ছে, যা বিভিন্নভাবে বিক্রি ও বাজারজাত করা হচ্ছে। ফলে সঠিক, মানসম্মত ও পুষ্টিকর মাংস পাওয়া যাচ্ছে না। যদি সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বৈধভাবে মহিষ আমদানি করা হয়, তাহলে খামারিরা খামার করতে আগ্রহ ফিরে পাবেন এবং সরকার কয়েক শ কোটি টাকার রাজস্ব পাবে। এতে বেকারত্বও অনেকটা কমে আসবে। সার্বিকভাবে সারা দেশে ২ লাখ বেকারের কাজের সুযোগ তৈরি তো হবেই, এতে বিপন্ন হতে যাওয়া মহিষের জাতটিও রক্ষা পাবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি অনুবিভাগ) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘মহিষ আমদানি নিষিদ্ধ নয়। তবে কিছু অশুল্ক বাধা রয়েছে। আমরা বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব। নতুন আমদানি নীতিও তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছে তথ্য নেব। সবকিছু ঠিক থাকলে মহিষ আমদানির ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অনাপত্তিপত্র ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’