নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনার পর এখন একই উদ্দেশ্যে তা বিক্রি শুরু করেছে । আগস্টের তিন সপ্তাহে ২২ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৃহস্পতিবারও ৮৫ টাকা ২০ পয়সা দরে ২ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাগেছে।
আমদানি কমা ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় ডলারের সরবরাহও বেড়েছে। এমন বাস্তবতায় বাজার স্বাভাবিক রাখতে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
তবে আমদানি বাড়া ও রেমিট্যান্সের মন্থর গতির কারণে বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় টাকার মান ধরে রাখতে মুদ্রাটি বিক্রি শুরু করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকায় অস্বাভাবিক দাম বাড়ার শঙ্কা নেই। রিজার্ভে রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন (চার হাজার ৮০০ কোটি) ডলারের বেশি জমা আছে। প্রয়োজনমতো সেখান থেকে ডলার বাজারে ছাড়া হবে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, চাহিদা বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রি স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। এটা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়।
বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ হস্তক্ষেপকে সময়োপযোগী একটা পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন তারা।
গত ৫ আগস্ট থেকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ছে। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকা ৪০ পয়সা দর হারিয়েছে।
৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর।
গত তিন সপ্তাহে তা অল্প অল্প করে বেড়ে বৃহস্পতিবার ৮৫ টাকা ২০ পয়সায় উঠেছে।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা:
দাম বাড়ার লাগাম টেনে ধরতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার ছাড়ছে বলে মনে করছেন গবেষক ও ব্যাংকাররা। তারা বলেছেন, আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়ছে দর।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমদানি বাড়ায় ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। গত অর্থবছরে প্রচুর রেমিট্যান্স আসায় ডলারের সরবরাহ বেড়ে গিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে তেমনটি থাকবে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে।
‘অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স বাড়েনি। চলতি আগস্ট মাসেও ধীরগতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি অনেক বেড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। আর চাহিদা বাড়লে যেকোনো পণ্যের দাম যেমন বাড়ে, ডলারের দামও তেমনি বাড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। আর এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করে ডলারের দাম বাড়ার সুযোগ করে দিয়ে ঠিক কাজটিই করছে বলে আমি মনে করি।
‘এর ফলে রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ীরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। টাকার মান বেড়ে গেলে অর্থনীতির এই দুই সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত।’
আহসান মনসুর বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে প্রবাসী আয় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যদি রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে থাকে তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখানে এমন নিয়মিত হস্তক্ষেপ করতে হবে।
‘রেমিট্যান্স কমতে থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও ডলার বিক্রি করতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি—সব ধরনের পণ্যের আমদানি বাড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বাংলাদেশে করোনা মহামারির মধ্যেই পুরোদমে উৎপাদন কর্মকাণ্ড চলছে।
‘সব মিলিয়ে আমদানি বাড়াটাই স্বাভাবিক। আর এটা অর্থনীতির জন্য মঙ্গল।’
তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে ডলারের চাহিদা বাড়ায় দাম বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করছে। এতদিন বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনা হয়েছিল। এখন সেই একই কারণে বিক্রি করা হচ্ছে।
‘এই কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময়ই করে থাকে। যখন যেটা প্রয়োজন, সেটাই করা হয়।’
আর রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার আরও খানিকটা অবমূল্যায়ন হলে করোনার এ কঠিন সময়ে রপ্তানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হতো।
রেমিট্যান্স বাড়া ও আমদানি কমায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সব মিলিয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, যা ছিল অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি।
মহামারির মধ্যে ব্যবসায় মন্দাজনিত কারণে আমদানি কমে যায়। পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন এবং রপ্তানি আয় বাড়ার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ডলার জমা হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনার এ রেকর্ড গড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন (৫১৫ কোটি) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরের আগে সেটিই ছিল সর্বোচ্চ ডলার কেনার রেকর্ড।
ডলারের দরের ওঠানামা:
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৪ সালের আগস্টে ডলারের আন্তব্যাংক মুদ্রা বিনিময় হার ছিল ৭৭ টাকা ৪০ পয়সা। ২০১৫ সালের আগস্টে এই দর বেড়ে হয় ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা। ২০১৬ সালের আগস্টে ডলারের দর ছিল ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা।
২০১৭ সালের আগস্টে ডলারের দর বেড়ে হয় ৮০ টাকা ৭০ পয়সা। ২০১৮ সালের আগস্টে ডলারের দর ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা হয়।
২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। তবে এর পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ডলারের দর আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে।
ওই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ ডলারের দর একটু একটু করে বেড়ে আবার ৮৪ টাকা ৯০ পয়সায় উঠে আসে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৯৫ টাকা। জুনে ওই দর কমে ৮৪ টাকা ৮৫ পয়সায় নেমে আসে। এর পর থেকে ডলারের দর চলতি বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৮৪ দশমিক ৮০ টাকায় স্থির ছিল।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন (দুই হাজার ৪৭৮ কোটি) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
তবে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহে ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৮৭ কোটি ডলার এসেছে। এ অঙ্ক গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৩৯ শতাংশ কম। আর আগস্টের ২৩ দিনে (১ থেকে ২৩ আগস্ট) ১৪০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
অন্যদিকে মহামারির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরের পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন (তিন হাজার ৮৭৬ কোটি) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
ওই অর্থবছরে ৬৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন (ছয় হাজার ৫৬০ কোটি) ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি।