নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
কৃষিপণ্য বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন আশা জাগাচ্ছে। করোনা মহামারির মধ্যেই গত অর্থবছরে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক অতিক্রম করেছে কৃষিপণ্য রপ্তানি বাণিজ্যের এই খাত। চলতি অর্থবছরেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে জানাগেছে।
চলতি বাজেটে কৃষিপণ্যের ছয় খাতে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেয়া হয়েছে; তার প্রভাবে রপ্তানি আরও বাড়বে বলে আশা করছেন রপ্তানিকারকরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য দেখা যায়, ১০ বছর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে ৪০ কোটি ডলার বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আড়াই গুণের বেশি বেড়ে ১০২ কোটি ৮১ লাখ ডলারে পৌঁছে।
বর্তমান বাজারদরে টাকার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ২০ পয়সা) এই অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের হিস্যাই বেশি।
গত চার বছর ধরে খাতটির রপ্তানি আয় বাড়ছে। অবশ্য করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি ৫ শতাংশ কমেছিল। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে খাতটির রপ্তানি আয় ১৯ শতাংশ বেড়ে প্রথমবারের মতো ১ বিলিয়ন ডলারের ‘ঘর’ অতিক্রম করে। যদিও পুরো বছরটিই করোনা মহামারির মধ্যেই কেটেছে।
গত অর্থবছরে এ খাত থেকে আশাব্যঞ্জক বিদেশি মুদ্রা আসার পর ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১১০ কোটি ৯২ লাখ ডলার।
ইপিবির হালনাগাদ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, অর্থবছরের শুরুটা বেশ ভালোভাবেই হয়েছে। প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট সময়ে কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে ২০ কোটি ৭২ লাখ ৩০ হাজার ডলার আয় হয়েছে। টাকার হিসাবে এই অর্থ ১ হাজার ৭৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
এই দুই মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।
যেসব পণ্য রপ্তানি:
কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে বেশি রপ্তানি হয় রুটি, বিস্কুট ও চানাচুরজাতীয় শুকনা খাবার, ভোজ্যতেল ও সমজাতীয় পণ্য, ফলের রস, বিভিন্ন ধরনের মসলা, পানীয় এবং জ্যাম-জেলির মতো বিভিন্ন সুগার কনফেকশনারি।
বিস্কুট, রুটিজাতীয় শুকনা খাবার রপ্তানি করে বিদায়ী অর্থবছরে দেশীয় কোম্পানিগুলো ২৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার আয় করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৪৬ শতাংশ বেশি। এর বাইরে চা, শাকসবজি ও ফলমূলও রপ্তানি হয়েছে।
একসময় চা রপ্তানি করে বেশ ভালোই আয় করত বাংলাদেশ। কিন্তু এখন তা তলানিতে নেমে এসেছে। গত অর্থবছরে মাত্র ৩৫ লাখ ৬০ হাজার ডলারের চা রপ্তানি হয়েছে।
তবে এখন শাকসবজি রপ্তানি থেকে বেশ আয় করছে বাংলাদেশ। প্রতিবছরই বাড়ছে এ খাতের রপ্তানি। গত অর্থবছরে ১১ কোটি ৮৭ লাখ ৩০ হাজার ডলারের বিদেশি মুদ্রা এসেছিল শাকসবজি রপ্তানি থেকে। এবার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১২ কোটি ডলার। জুলাই-আগস্ট মাসে এসেছে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০২ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যের চেয়ে বেশি ৩৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
জুলাই-আগস্ট সময়ে শুকনা খাবার রপ্তানি করে ৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। তামাক রপ্তানি করে এসেছে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার। মসলা রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে প্রায় ১ কোটি ডলার।
মোট রপ্তানির ১৬ শতাংশই করে প্রাণ:
কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) তথ্য অনুযায়ী, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান আছে ২০টি। এগুলোর সবাই কম-বেশি রপ্তানি করছে। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে বর্তমানে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার।
কৃষিপণ্যের রপ্তানির বড় অংশ করে প্রাণ গ্রুপ। ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা (৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলার), যা এ খাতের মোট রপ্তানির ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।
১৯৯৭ সালে ফ্রান্সে খাদ্যপণ্য রপ্তানি শুরু করা এই শিল্পগোষ্ঠী বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকা, পাশের দেশ ভারতসহ ১৪৫টি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। ফ্রুট ড্রিংক, পানীয়, বিস্কুট, সস, নুডলস, জেলি, মসলা, সুগন্ধি চাল, পটেটো ক্র্যাকার, চানাচুর, ঝাল-মুড়ি ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি করছে প্রতিষ্ঠানটি।
রপ্তানি আরও বাড়বে:
আগামী দিনে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের চাহিদা আরও বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের সম্ভাবনা ব্যাপক। তৈরি পোশাক মানুষ যেমন গ্রহণ করছে, তেমনি তৈরি খাদ্যও মানুষ কিনছে ও খাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদিত হয় না। তারা মূলত আমদানিনির্ভর। সব মিলিয়ে আগামী দিনে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের চাহিদা আরও বাড়বে। পণ্যটির রপ্তানি বাড়াতে হলে আমাদের দেশের কৃষিকে আরও বেশি উৎপাদনমুখী হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘কেবল ধান উৎপাদন করলে হবে না। পাশাপাশি বেশি মূল্যের ফলমূল, বাদাম, মসলা, বীজজাতীয় শস্য উৎপাদনে যেতে হবে। তাছাড়া বন্দরের সক্ষমতা, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও স্বল্প খরচের উৎপাদনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের নিরাপত্তা, পরিবেশ ও মানে কোনো প্রকার আপস করা যাবে না।
‘তদারকি সংস্থাগুলোরও সচেতন হতে হবে। ভারতের মতো আমাদের দেশেও ফুড পার্ক করা যেতে পারে। তা ছাড়া প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনে শীর্ষস্থানে থাকা থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। তাহলে আমাদের উদ্যোক্তারা নতুন কিছু শিখবে। শিল্পটিও এগিয়ে যাবে।’
কৃষিপণ্য উৎপাদনে ১০ বছরের কর অবকাশ:
করোনাভাইরাসের এই সংকটের সময়ে দেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে এবং বিনিয়োগ খরা কাটাতে উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ কিছু খাতে কর ছাড় দেয়া হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে। এর মধ্যে কৃষিপণ্যের ছয় খাতে থাকছে ১০ বছরের কর অবকাশ।
ফল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন, সম্পূর্ণ দেশীয় কৃষি হতে শিশু খাদ্য উৎপাদনকারী শিল্প এবং কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনে নতুন বিনিয়োগে থাকবে ১০ বছরের করমুক্তি সুবিধা।
২০৩০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যারা এ খাতে বিনিয়োগ করবেন, তারা এই আয়কর অব্যাহতির সুবিধা পাবেন। এই করমুক্তি সুবিধা নিতে ন্যূনতম এক কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে বিডার নিবন্ধন নিতে হবে। কাঁচামাল পুরোটাই দেশে উৎপাদিত হতে হবে।
এর যুক্তি হিসেবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘দেশীয় কৃষিভিত্তিক শিল্পে বাংলাদেশে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিজাত পণ্যের আমদানি বিকল্প তৈরির মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ও কমর্সংস্থান সম্ভব। একই সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যের এ যুগে কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজন ও বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক রপ্তানি বাণিজ্যের দখল নেয়া সম্ভব।’
সরকারের এই করমুক্তি সুবিধা কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক এম আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘উদ্যোক্তারা যদি সরকারের এই সুবিধা নিয়ে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে, তাহলে কৃষি খাতে আমূল পরিবর্তন আসবে। এ খাত থেকে আরও বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসবে।’
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আম-টম্যাটোসহ আমাদের অনেক কৃষিপণ্য পচে নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো যদি ভালোভাবে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা যায় তাহলে একদিকে যেমন বিদেশি মুদ্রা দেশে আসবে, অন্যদিকে কৃষকও ভালো দাম পাবেন।’
আম কূটনীতিকে কাজে লাগানোর পরামর্শ:
কৃষিপণ্য আম উৎপাদনে বাংলাদেশ অষ্টম থেকে সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে। এবার দেশে প্রায় ১৫ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু আমের রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে একেবারে তলানিতে; নামমাত্র কিছু আম রপ্তানি হয়। এগুলোও আবার প্রবাসী বাংলাদেশি ক্রেতাদের জন্য রপ্তানি করা হয়।
গত ১৮ জুলাই কৃষি মন্ত্রণালয়ে ‘আম রপ্তানি বৃদ্ধিতে করণীয়’ বিষয়ে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আমচাষিসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা অংশ নেন। সভায় দেশে নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম চাষ এবং আমের আন্তর্জাতিক বাজার অনুসন্ধানের ওপর জোর দেয়া হয়।
ওই সভায় জানানো হয়, ২০২০ সালে থাইল্যান্ড বিশ্বের সর্বোচ্চ ৭৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের আম রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ১৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার ও পাকিস্তান ১০ কোটি ১০ লাখ ডলারের আম রপ্তানি করেছে। সেখানে বাংলাদেশ মাত্র ৫০ হাজার ডলারের (৪২ লাখ টাকা) আম রপ্তানি করেছে, যার বড় অংশ মূলত প্রবাসী বাংলাদেশি ক্রেতাদের জন্য রপ্তানি করা হয়েছে।
বিদেশে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে, রপ্তানিযোগ্য উন্নত জাতের আমের অভাব। দেশের আমের জাতগুলোর সেলফ লাইফ কম, অর্থাৎ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। সংগ্রহ-পরবর্তী পর্যায়ে শনাক্তকরণের অভাব, আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিংয়ের অভাব। আর দেশের আমের ব্র্যান্ডিং ইমেজ সৃষ্টি না হওয়া এবং রপ্তানি কার্যক্রমে দক্ষতা, সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের অভাব।
আম রপ্তানি বাড়াতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন, ‘দেশের আমকে আমরা ব্যাপকভাবে বিশ্ববাজারে নিয়ে যেতে চাই। সে জন্য রপ্তানি বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনে কাজ চলছে। ইতিমধ্যে নিরাপদ আমের নিশ্চয়তা দিতে তিনটি ভ্যাকুয়াম হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ চলছে। উৎপাদন থেকে শিপমেন্ট পর্যন্ত আম নিরাপদ রাখতে উত্তম কৃষিচর্চা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট দেয়ার কাজ চলছে।’
ফলে আগামী বছর আম রপ্তানির পরিমাণ অনেক বাড়বে বলে জানান মন্ত্রী।
কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাদু আম উপহারের বিষয়টি এবার বেশ আলোড়ন তুলেছিল। শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত নয়, বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহ, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর জন্য উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে ফলের রাজা আম।
এই আম উপহারের ফলে বাংলাদেশের সুস্বাদু আম নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও এসেছে বিষয়টি।
‘এই এখন রপ্তানিতে কাজে লাগাতে হবে’ জানিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘একটা ভালো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটাকে কাজে লাগাতে পারলে আম রপ্তানি থেকে প্রচুর বিদেশি মুদ্রা দেশে আসবে।’