নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংস্কার ও ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে দেশের পৌরসভাগুলোতে একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে, এরপর পর্যায়ক্রমে সব পৌরসভাতেই হবে এই নিয়োগ। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন পৌরসভার মেয়রদের মাঝে।এই নিয়োগের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
সিইও নিয়োগ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, পৌরসভার সার্বিক কার্যক্রম গতিশীল করতে এবং স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ পৌরসভাতে রাজস্ব আদায়ের কাজটি নিয়মিত হয় না। যে কারণে অনেক পৌরসভাই নিজেদের কর্মীদের বেতন-ভাতা নিজেরা সংস্থান করতে পারে না। এ কারণে পৌরসভার কার্যক্রমে গতি আনতে এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
যদিও সরকার বলছে, পৌরসভার কাজে গতিশীলতা আনার জন্যই এই উদ্যোগ। কিন্তু নির্বাচিত মেয়রদের প্রায় সবাই সিইও নিয়োগে প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন না। বরং এ নিয়োগে কাজে জটিলতা বাড়বে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। সিইও’র বেতন কোথা থেকে হবে এবং তিনি জনপ্রতিনিধিদের কাজে হস্তক্ষেপ করবেন কি-না, এই প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র। তারা মনে করছেন, আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পৌরসভায় সিইও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
মেয়রদের আশংকা এর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাজের স্বাধীনতা ও পরিবেশ ব্যাহত হতে পারে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তাদের মতামতও নেওয়া হয়নি বলে জানান তারা।
দেশে বর্তমানে পৌরসভার সংখ্যা ৩২৮। প্রথম শ্রেণির পৌরসভা বলতে সিটি করপোরেশনের বাইরে পুরনো ও বড় জেলার পৌরসভাকে বোঝানো হয়। এমন পৌরসভার সংখ্যা ১৯৪।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ২৩ মার্চ স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জনপ্রশাসনসচিবের কাছে চিঠি পাঠান। চিঠিতে পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়নের জন্য পর্যায়ক্রমে উদ্যোগ নিতে বলা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদায়ন না করা পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে জেলা সদরের পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত একজন ‘সিনিয়র সহকারী কমিশনার’ বা ‘সহকারী কমিশনার’কে তাঁর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
এরই মধ্যে মেহেরপুর ও কক্সবাজার পৌরসভায় জুন মাস থেকে সরকারের সহকারী কমিশনার পদের দুই কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের ৩২৮ পৌরসভার মধ্যে ১৯৪টি ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হবে। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এ বলা হয়েছে, সরকার নির্ধারিত শর্তে পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁর অধীনে থাকবেন।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনেই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। দেশের চারটি পৌরসভায় (ভোলা, সাভার, নারায়ণগঞ্জের তারাব ও ফরিদপুর) আগে থেকেই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রয়েছেন।
দেশের সিংহভাগ প্রথম শ্রেণীর পৌরসভার মেয়রের চেয়ারে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই। যে কারণে সরকার এই পদক্ষেপের সরাসরি বিরোধিতা বা প্রতিবাদ জানাতে পারছেন না, এমনকি প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানানো থেকেও অনেক মেয়র বিরত আছেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেয়রদের কেউ কেউ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।
টানা তিন মেয়াদে নির্বাচিত একজন বর্ষিয়ান মেয়র বলেন, এত বছর সরকার প্রধান নির্বাহী নিয়োগ করেনি। এখন জনপ্রতিনিধিদের চাপে রাখতে আমলারা পৌরসভায়ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিচ্ছে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। পৌরসভার ক্ষেত্রেও এমন দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।
পৌরসভা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের গতথ্য অনুযায়ী, ১ মাস থেকে ৬০ মাস পর্যন্ত বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে ১৯০টির বেশি পৌরসভায়।
পৌরসভার মেয়রদের সংগঠন মিউনিসিপ্যাল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শ্রীপুর পৌরসভা মেয়র আনিসুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রধান নির্বাহী দেওয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। যে পৌরসভার সিইও প্রয়োজন হবে, সে চেয়ে নেবে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খেতে হয়। প্রথম শ্রেণির গেজেটেড একজন কর্মকর্তার বেতন-ভাতাও তখন পৌরসভার কাঁধে যুক্ত হবে।
দেশের বিভিন্ন উপজেলা পরিষদে স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের সাথে প্রশাসনের মতভেদ ও দ্বন্দ্বের কথা প্রায়ই শোনা যায়। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের আশংকা সে দ্বন্দ্ব সামনের দিনে পৌরসভার ক্ষেত্রেও ঘটতে দেখা যাবে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলছেন, সরকার যদি পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই উদ্যোগ নেয়, তাহলে সেটি সফল হবার সম্ভাবনা কম।কারণ সক্ষমতা বাড়াতে হয় ভেতর থেকেই। কিন্তু সরকার যদি এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেটি সম্ভব।”
উপজেলা পর্যায়ে চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের সাথে প্রশাসনের দ্বন্দ্বের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে যেটা দেখা যায় যে এখন উপজেলাগুলোতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারেরা চেয়ারম্যানদের ঠিক মানতে চান না। আবার সরকার ইউএনওদের কথা শোনে, চেয়ারম্যানদের কথা শোনে না। ঠিক একই জিনিস পৌরসভাতেও হবে বলে আমার আশংকা।
স্থানীয় সরকার বিভাগের একাধিক কমকর্তা জানান, পৌরসভার প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও প্রকৌশল—তিনটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানেরা সিইওর অধীন থাকেন—প্রশাসন বিভাগের প্রধান সচিব, স্বাস্থ্য বিভাগে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং প্রকৌশল বিভাগে প্রধান প্রকৌশলী। সিইও না থাকলে তাঁরা নিজ নিজ বিভাগের নথি পাঠান মেয়রের কাছে। পৌরসভায় সিইও থাকলে তিন বিভাগের নথি তাঁর কাছে যাবে। তিনি এসব নথি মেয়রের কাছে উপস্থাপন করবেন।
মেয়র বা পৌর সচিবদের সঙ্গে সিইওদের বিরোধের আৈইনত কোনো কোনো সুযোগ নেই বলে তারা মনে করছেন।