নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
রাজধানীর অদুরে সাভারের পরিবেশ দূষণের কারণে সম্প্রতি হরিণধরা এলাকায় চামড়া শিল্পনগরী বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। চালু হওয়ার চার বছরের মধ্যে এটি বন্ধের দাবি উঠতে শুরু করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর চামড়া শিল্পনগরী কেন বন্ধ করা হবে না, বিসিকের কাছে এর কারণ জানতে চেয়েছে। অপরদিকে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মালিক ও শ্রমিকরাও পরিবেশ দূষণ রোধ করে সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি কামনা করেছেন।
বিসিক বলছে, ট্যানারিগুলো প্রয়োজনের বেশি পরিমাণ পানি ব্যবহার করায় তা সিইটিপির শোধন ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে সলিড বর্জ্যকে রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার করলে এই সমস্যা সমাধান হবে। এই লক্ষ্যে নতুন একটি প্রকল্প নিয়ে তারা এগুচ্ছে।
গত ২৩ আগস্ট পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দূষণের কারণে চামড়া শিল্প নগরী বন্ধের সুপারিশ করে। সাভারের হরিণধরা এলাকায় চামড়া শিল্পনগরীতে গিয়ে পরিবেশ দূষণ দেখতে পায়।
শিল্পনগরীতে গিয়ে দেখা যায়, শেষ প্রান্তে সড়কের দুই পাশে স্তুপ করে রাখা হয়েছে কঠিন বর্জ্য। কোথাও কোথাও ড্রেন উপচে রাসায়নিক মিশ্রিত কালো পানি চলে এসেছে সড়কে। উৎকট গন্ধের কারণে সড়ক দিয়ে চলাচল দায় হয়ে পড়েছে শ্রমিকদের। বর্ষাকালে কিংবা বৃষ্টি হলেই ট্যানারি বর্জ্য মিশ্রিত পানি সড়কে চলে আসে। তখন ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়।
কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) পাশেই ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেঁষে রীতিমত ভরাট হয়ে গেছে ট্যানারির কঠিন ও তরল বর্জ্যে, যা নদীর জন্যে হুমকি।
স্বাধীন ট্যানারির শ্রমিক মোহাম্ম বাশার বলেন, ‘রাস্তাঘাট নোংরা হয়ে থাকার কারণে আসা-যাওয়া খুব কষ্ট হয়। রাস্তার দুই পাশে ময়লা রাখার কারণে পানি কোনো পাশে যাইতে পারে না। এই জন্য সমস্যা হয়।’
রাসেল মিয়া নামে ট্যানারির আরেক শ্রমিক বলেন, ‘আমি ভাত খাইয়া এই দিক দিয়া আসলে গন্ধে আমার মাথা ঘুরে। সব সময় ৫ টাকা অটো ভাড়া দিয়া ফ্যাক্টরিতে যাই। কিন্তু বৃষ্টি হইলে ১০ টাকা দিলেও অটো এই দিকে আসে না। তখন পুরা রাস্তা ময়লার পানিতে ডুইবা যায়। ওই হাইটা গেলেও পায়ে পাঁচড়া (চুলকানি) হয়। অনেক সময় গাড়িগুলা রাস্তার মইদ্দেও ময়লা ফালায় যায়।’
এত সমস্যা নিয়েও ট্যানারি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে চান এই পেশার সঙ্গে ৩০ বছর ধরে জড়িত কবির হোসেন। বর্তমানে গ্রিনঅ্যারো ট্যানারিতে কাজ করেন তিনি।
কবির বলেন, ‘ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের রিজিকের উপর আঘাত আসবে। এটা আমরা কোনোভাবে মাইনা নিতে পারব না। এর জন্যে বিসিক একমাত্র দায়ী। এমনকি যারা এইটার পৃষ্ঠপোষক, সরকারও এইটার জন্য দায়ী। এইটার দায় কারা নিবে, কী করবে যাতে এই শিল্পটা বাঁচে। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার পরে এটা গোল্ডরেও হার মানায়।’
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের মারাত্মক ধরনের ত্রুটি ছিল। পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার মূল কম্পোনেন্ট সিইটিপি (কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার)। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা সঠিকভাবে আজ পর্যন্ত ফাংশনিং করছে না। এটা সরকারও স্বীকার করে এবং সর্বজনস্বীকৃত।
‘এটার জন্য সরকারের যে দায়িত্ব পালন করা উচিত, আর মালিকদের যে রেসপন্সিবিলিটি – কেউই তা মানছে না। তাই সংসদীয় কমিটির ট্যানারি বন্ধ করে দেয়াার সুপারিশের মতো সিদ্ধান্তে আমরা বিক্ষুব্ধ।’
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘ট্যানারি বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান হতে পারে না। আমরা মালিকরা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে হাজারীবাগ থেকে এখানে এসে বিনিয়োগ করেছি। এখন আমাদের প্রোডাকশন বেড়েছে। এই সময় এমন সুপারিশের কারণে মালিকরা বিপাকে পড়েছেন। এমন আত্মঘাতী সুপারিশ করার আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল।’
তবে পরিবেশকে বাঁচাতে চামড়া শিল্পনগরী বন্ধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে দাবি পরিবেশবিদদের।
সাভার নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ড. রফিকুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘এটা লাল চিহ্নিত একটা ইন্ডাস্ট্রি। লাল মানে ভয়াবহ। সেই লাল চিহ্নিত ইন্ডাস্ট্রি লোকালয়ে করা হলো। প্রথম থেকেই আমরা এটাতে সম্মত ছিলাম না। এই চামড়া শিল্পে শুধুমাত্র তরল বর্জ্যের কারণে যে দূষণ হচ্ছে তা নয়। এখানে ক্রোমিয়াম এসিডের মতো মারাত্মক গ্যাস আছে এবং সলিড আছে ওয়েস্ট। এগুলাতো মিনিমাইজেশনের কোনো ব্যবস্থাই নাই। সলিউবল অক্সিজেন এখানে অনেক কম। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, এখানে স্যালাইনিটি অনেক বেশি। এসব জিনিসের এখানে মিনিমাইজেশন দরকার। সোজা কথা এটা, জোড়াতালি দিয়ে করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির সুপারিশ করার আগে অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। এটা সরকার ও তাদের ব্যাপার। আমাদের মতে, এই ট্যানারি এখানে আদৌ করা উচিত হয়নি। এটাকে সরিয়ে নেওয়াই সঙ্গত।’
তবে ট্যানারির দূষণের কথা স্বীকার এই শিল্পকে বাঁচাতে চলমান সমস্যা নিরসনে কাজ করে যাওয়ার কথা জানিয়েছে বিসিক।
বিসিকের জেনারেল ম্যানেজার জীতেন্দ্র নাথ পাল বলেন, ‘হাজারীবাগে ট্যানারির প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি ছিল কম। এখানে এসে প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি অনেক গুণ বেড়ে গেছে। তবে আমাদের দুর্বলতা ফিজিবিলিটি স্টাডিতে। হাজারীবাগকে রেখে হয়ত কিছু বাড়ানো হয়েছে।
‘আমি নিজেও বলব, এটা যদি আর একটু চিন্তা ভাবনা করা যেত যে, ৫০ কিংবা ১০০ বছর মেয়াদি, তাহলে সিইটিপির যে ক্যাপাসিটি ২৫ হাজার কিউবি সেটা বাড়ানো যেত। তাহলে কিন্তু আজকে এই অবস্থা হতো না। আর এখন ৪০ থেকে ৫০ হাজার কিউবি যেটা যাচ্ছে, এটা কিন্তু কোরবানির ঈদের এই তিন মাস যাচ্ছে। সারা বছর কিন্তু এটা থাকে না, ১৫ থেকে ২০ হাজার কিউবির ভিতরেই থাকে।
‘তবে আমাদের পানির ইউজটা কিন্তু পরিমিত করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল নিয়ম অনুযায়ী, ১ টন চামড়া প্রসেস করার জন্য ৩০ হাজার লিটার পানি ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যবহার হয় ৬০ হাজার লিটার পর্যন্ত। আর পরীক্ষা করেও আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের সিইটিপিতে সেই ধরনের কোনো সমস্যা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে সলিড ওয়েস্টটা নিয়ে সমস্যা। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, এসপিজিএস অর্থাৎ স্ল্যাশ থেকে ইলেকট্রিসিটি তৈরি করা হবে, যেটা টেকনিক্যালি ঠিক না হওয়ায় বাতিল করা হয়েছে। নতুন একটা প্রজেক্ট পরবর্তীতে হাতে নেয়া হয়েছে। সেই প্রজেক্টেটার প্ল্যানিং গবেষণায় যাচাই-বাছাই চলতেছে। মূলত এই সলিড ওয়েস্টগুলা কিন্তু আমাদের সম্পদ, ফেলার কোনো জিনিস নয়। এগুলিকে আমরা রিসাইক্লিং, রিইউজ করার পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছি। এগুলি যখন সম্পদে পরিণত হবে তখন এই সমস্যাটা সমাধান হবে। তাছাড়া ডাম্পিং ব্যবস্থা চিরদিনের জন্য নয়। এটা করলে আমরা সবদিক দিয়েই উপকৃত হব।’
রাজধানীর হাজারীবাগে নদী দূষণের কারণে চামড়াশিল্পকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরিবেশে উন্নীত করতে সাভারের হেমায়েতপুরে শিল্পনগরী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় বিসিক। ২০০৩ সালে শুরু করা প্রকল্প ১ হাজার ১৫ কোটি ব্যয়ে ১৭ বছরে বাস্তবায়িত হয়। ২০১৭ সালে ১৩০টি ট্যানারি একযোগে উৎপাদন শুরু করলেও বর্জ্য শোধন সমস্যায় ধুকছে এই বিসিক শিল্প নগরী।