নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
বিশ্বের উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও এ দেশেও ইলেকট্রিক ট্রেন চালুর স্বপ্ন দেখছেন।জ্বালানী সাশ্রয়ী ও দ্রুতগতির এ ট্রেন চালু হলে রেলের লোকসান দূর হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। কিন্তু এর প্রাথমিক কাজই এখনও বাস্তবের মুখ দেখেনি। কাগুজে-কলমেই পার হল অর্ধ যুগ।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, দেশে প্রথম ইলেকট্রিক ট্রেন চালুর সমীক্ষা বা সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়ার কথা ছিল। এ জন্য রেল মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী গুরুত্ব বিবেচনায় তাতে ‘আলাপ করুন’ লিখেও দেন। এর পর গত সাড়ে পাঁচ বছর এ সম্ভাব্যতা নিয়ে ফলপ্রসু কোনো আলাপই করেনি রেল মন্ত্রণালয়।
এখন নতুন করে আবারও এর ফাইল নড়াচড়া শুরু হয়েছে। আবারও প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
কমিশন বলছে, রেল মন্ত্রণালয়ের প্রথম প্রস্তাব মতে, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা চিন্তা করে বন্দর জেলা নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজধানী ঢাকা হয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইলেকট্রিক ট্রেনের প্রথম রুট ধরা হয়েছে।
এ রুটে ইলেকট্রিক ট্রেন ও এর ট্র্যাক নির্মাণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই সমীক্ষা প্রকল্প। প্রায় ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে এ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
সম্ভাব্যতা সংক্রান্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে পরের বছরই মূল প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে এখন সে সমীক্ষা প্রকল্পের ব্যয় ৫ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা করার নতুন প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। নতুন মেয়াদ ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত।
ফাইল ছবি
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের শুরুতে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পটি পাঠায় রেলপথ মন্ত্রণালয়। ওই বছরের জানুয়ারিতে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সমীক্ষা ব্যয় দেড় কোটি টাকা কমানোর কথা বলা হয়।
৮ কোটি ১২ লাখ টাকার সমীক্ষা প্রকল্পটির সারসংক্ষেপ ছয় মাস পর পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। মন্ত্রী গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ‘আলাপ করুন’ লিখে দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই মাসে পর্যালোচনা সভা হয়।
এরপর প্রায় তিন বছর প্রকল্পের ‘আলাপ’ থেমে থাকে। ২০১৯ সালের জুলাইতে দ্বিতীয় পিইসি সভা হয়। এক বছরের বিরতিতে ২০২০ সালের মাঝামাঝি প্রকল্পটির প্রস্তাব আবার আসে কমিশনে। এরপরও প্রায় এক বছর পার হয়েছে।
রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ইলেকট্রিক ট্রেন জ্বালানি সাশ্রয়ী ও উচ্চ গতিসম্পন্ন। এ ট্রেনের পরিচালন খরচ কম, ভ্রমণ সময়ও কম লাগে। বছর বছর ভাড়া বাড়ানোর ঝামেলা থেকেও যাত্রীরা রেহাই পাবে। সরকারকেও ভর্তুকির অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হবে না।
ইলেকট্রিক ট্রেন কেন সাশ্রয়ী:
বর্তমানে দেশের সবগুলো ট্রেন ডিজেলচালিত। এতে একটি ট্রেনকে প্রতি কিলোমিটারে কমপক্ষে ১ হাজার টাকা জ্বালানি খরচ গুণতে হয়। কিন্তু ইলেকট্রিক ট্রেনে প্রতি কিলোমিটারের জ্বালানি খরচ ৫০ টাকার নিচে।
দেশে ট্রেনের প্রধান রুট ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। এটি পাড়ি দিতে ট্রেনের সময় লাগে প্রায় ৬ ঘণ্টা। ইলেকট্রিক ট্রেন হলে ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার গতিতে প্রধান কয়েকটি স্টেশনে যাত্রী ওঠানামাসহ সর্বোচ্চ সময় লাগবে ২ ঘণ্টা।
মূলত বন্দরনগরী দিয়ে দেশের আমদানি-রপ্তানির প্রায় পুরোটা নিয়ন্ত্রিত হয়। অপরদিকে রাজধানী ঢাকাসহ এ বিভাগের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ। এ তিন অঞ্চলে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ বাস করে। আবার চট্টগ্রাম বন্দরের মালামাল পরিবহনে এ পথে কম সময় লাগবে। তাই বাণিজ্যিক দিক দিয়ে শুরুতে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সমীক্ষা চালানো হবে।
সমীক্ষায় নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ইলেকট্রিক ট্রেন নির্মাণে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন, বিদ্যমান লাইনে তা সম্ভব কিনা, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য স্থান নির্বাচন, বিদ্যুতের সাব স্টেশন নির্মাণে উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন, লাইনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগে (ওভারহেড ক্যাটেরিং সিস্টেম) জন্য আধুনিক প্রযুক্তি নির্ধারণ এবং প্রকল্পটির আর্থিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপযোগিতা যাচাই করা হবে। এর ভিত্তিতে প্রকৌশল নকশা প্রণয়ন, মূল প্রকল্পের বিস্তারিত ব্যয় প্রাক্কলন তৈরি হবে। সমীক্ষা প্রকল্পে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চার জন এবং স্থানীয় ১৩ জন পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হবে।
ফাইল ছবি
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হলে আগে এর উপযোগী অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। ইলেকট্রিক ট্রেনের লাইন নির্মাণ করতে হবে। পুরো পথে বিদ্যুতের লাইন বসাতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধাও থাকতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতই তো পাওয়া যচ্ছে না। চলতে চলতে যদি বিদ্যুৎ চলে যায়, তাহলে তো ট্রেন পথেই থাকবে। তবে সরকার চিন্তা-ভাবনায় আছে। অবকঠামো সংস্কার করার কাজ শুরু হবে। একটি স্টাডি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
সমীক্ষার উদ্যোগ কেন পাঁচ বছর ধরে পড়ে আছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ইলেকট্রিক ট্রেন চলানোর জন্য সমীক্ষা করার কথা ছিল। কিন্তু প্রথমত এ রুটে ডাবল লাইন করার প্রকল্প চলমান ছিল। তাই সেটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন ইলেকট্রিক লাইনের সমীক্ষায় নজর দেয়া যাচ্ছিল না। তবে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইলেকট্রিক ট্রেন করার প্রচেষ্টার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখন থেকে নতুন রেলপথ যেগুলো নির্মিত হবে, সেখানে ইলেকট্রিক সিস্টেম চালুর ব্যবস্থা থাকবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সমীক্ষার কাজ শিগগিরই শুরু হবে।’
রেলপথ বিভাগ বলছে, ডিজেলচালিত ট্রেনের চাইতে ইলেকট্রিক ট্রেনের গতি অনেক বেশি এবং একই সঙ্গে জ্বালানি খরচ অনেক সাশ্রয়ী। এমন অবস্থায় ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করলে রেলওয়েকে সাশ্রয়ী ও লাভজনক করা সম্ভব। ইলেকট্রিক ট্রেনে প্রতি কিলোমিটারে জ্বালানি খরচ হবে ৫০ টাকার নিচে। ডিজেল থেকে বিদ্যুতে পরিবর্তন করা গেলে শুধু জ্বালানি খরচই কমবে ৯০ শতাংশ। আর বর্তমানে রেলের অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয়ই লোকসানের প্রধান কারণ।
ইলেকট্রিক ট্রেন ব্যয়সাশ্রয়ী হলে তা এখনও কেন বাস্তবতার মুখে দেখছে না এ বিষয়ে অর্থনীবিদ ও আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রেল চলে ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে। আর ডিজেলেই সবচেয়ে বেশি চুরিটা হয়। দিনে-দুপুরেই তেল বা ডিজেল চুরি হয়। ইঞ্জিনের লাইন খুলে সবার সামনেই তেল অন্য ড্রামে করে সরিয়ে ফেলা হয়। ইলেকট্রিক ট্রেন হলে এ চুরি বন্ধ হয়ে যাবে। খরচ কমে গেলে অন্য খাতেও গরমিল করার সুযোগও কমে যাবে।’
তবে রেলপথ মন্ত্রণালয় আশা করছে, ভবিষ্যতে পদ্মাসেতু রেল লিংকসহ গুরুত্বপূর্ণ সব রুটেই ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হবে। নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পে নতুনভাবে ইলেকট্রিক ট্রেনের প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হবে। বিদ্যুতের যোগান হিসাবে মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুটি ইউনিটে ১২০০ মেগাওয়াট এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের আশা দেখছে তারা।