নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
বায়ুদূষণে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে গাজীপুর। অন্যদিকে সবচেয়ে কম দূষিত জেলার শীর্ষে রয়েছে মাদারীপুর। বায়ুদূষণে এর পরের অবস্থানে রয়েছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা। আর কম দূষিত জেলার পরের অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী ও মেহেরপুর। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র বা ক্যাপসের ৬৪ জেলার বায়ুমান সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে সমীক্ষার ফল প্রকাশ করে ক্যাপস।
প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন গবেষক দলের প্রধান ও স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ক্যাপস গত বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৪ জেলা শহরে ৭ ধরনের ভূমির ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের বস্তুকণার মান পরীক্ষা করে এসপিএসএস ও আর্কজিআইএস সফটওয়্যার ব্যবহার করে।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের প্রতি ঘনমিটারে গড় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল ১০২.৪১ মাইক্রোগ্রাম, যা দৈনিক আদর্শ মানের (৬৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে প্রায় ১.৫৭ গুণ বেশি।
এতে আরও বলা হয়, ৬৪ জেলার মধ্যে গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি দূষণ দেখা যায়, যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩.৫১ মাইক্রোগ্রাম। গাজীপুরের পরের অবস্থানে রয়েছে পাশ্ববর্তী জেলা ঢাকা। এরপরই নারায়ণগঞ্জের অবস্থান। এ দুই জেলার বায়ুমান ছিল যথাক্রমে ২৫২.৯৩ এবং ২২২.৪৫ মাইক্রোগ্রাম।
সবচেয়ে দূষিত তিনটি শহরের বায়ুমান ছিল বাংলাদেশের আদর্শমানের চেয়ে প্রায় ৪-৫ গুণ বেশি।
রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সংস্কারকাজ, মেগা প্রকল্প, আশপাশের ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্পকারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো এই প্রধান তিন শহর দূষণের অন্যতম কারণ বলেও সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণে তিনটি জেলার পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কিশোরগঞ্জ।
অপরদিকে সবচেয়ে কম দূষিত জেলার শীর্ষে মাদারীপুর জেলা, যার বায়ুমান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪৯.০৮ মাইক্রোগ্রাম। এর পরের অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী ও মেহেরপুর জেলা।
এসব এলাকায় প্রচুর পরিমাণ গাছপালা ও জলাধার থাকাকে বায়ুদূষণ কম হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
সমীক্ষায় ৬৪ জেলার মধ্যে ১০টিতে বায়ুমান ভালো, ৩৬টি জেলার বায়ুমান মধ্যম মানের এবং ১৮টি জেলার বায়ুমান অতিরিক্ত দূষিত বলে উল্লেখ করা হয়।
ভালো বায়ুমানের জেলা: কুড়িগ্রাম, নাটোর, জয়পুরহাট, রাজবাড়ী, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মেহেরপুর, পটুয়াখালী ও মাদারীপুর।
মধ্যম মানের দূষিত বায়ুর জেলা: যশোর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, শেরপুর, নেত্রকোণা, বরগুনা, খাগড়াছড়ি, সিলেট, গোপালগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, ঠাকুরগাঁও ও জামালপুর।
অতিরিক্ত দূষিত বায়ুর জেলা: গাজীপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, লক্ষীপুর, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, ফেনী, ঠাকুরগাঁও ও জামালপুর।
ক্যাপসের গবেষণা থেকে উঠে আসে, আটটি বিভাগীয় শহরের মধ্যে বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা শহর। সেখানে গড়ে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৫২.৯৩ মাইক্রোগ্রাম।
বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে বায়ু দূষণের তালিকায় সর্বনিম্নে রয়েছে রাজশাহী শহর। সেখানে প্রতি ঘনমিটারে গড়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল ৫৬.১ মাইক্রোগ্রাম।
দূষণ অনুযায়ী বিভাগীয় শহরগুলোর ক্রম হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-সিলেট-বরিশাল-রংপুর-খুলনা-রাজশাহী।
গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলা এবং পাহাড়ি এলাকার বায়ুদূষণের কথাও আলাদা করে উল্লেখ করা হয়।
গবেষণা থেকে দেখা যায়, উপকূলীয় এলাকার মধ্যে শুধু পটুয়াখালীর বায়ুমান ভালো পর্যায়ে ছিল। এ ছাড়া ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজার, নোয়াখালী এলাকার বায়ুমান অতিমাত্রায় দূষণ এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অপরদিকে, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, শরীয়তপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, বরগুনা এবং যশোর জেলা মধ্যম পর্যায়ের দূষণ এলাকার অন্তর্ভুক্ত।
পাহাড় থাকা এলাকার মধ্যে হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার জেলায় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ২২০.১১ এবং ১৫৮.৮১ মাইক্রোগ্রাম, যা নির্ধারিত মান মাত্রার ৩.৩৮ এবং ২.৪৪ গুণ বেশি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বায়ুদূষণ রোধে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ১৫ দফা সুপারিশ করা হয়।
১. শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলোতে প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা।
২. নির্মাণকাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখা ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেয়ার ব্যবস্থা করা।
৩. রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা।
৪. অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়ানো।
৫. ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা।
৬. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদ বাগান করার জন্য সবাইকে উৎসাহ দিতে হবে।
৭. আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করা।
৮. দূষিত শহরগুলোর আশপাশে জলাধার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৯. আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে স্যান্ড বক্লের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।
১০. সিটি গভর্ন্যান্সের প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করা।
১১. নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা।
১২. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশনের (ক্যামস) ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এ ছাড়াও বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেয়ার প্রচলন করতে হবে।
১৩. গণপরিবহনসহ ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
১৪. সংবাদমাধ্যমে বায়ুদূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্যনির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করা।
১৫. পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকরের ব্যবস্থা করা।
সমীক্ষার ফল উপস্থাপনের সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জসিম উদ্দিন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ডা. লেনিন চৌধুরী, প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগমসহ আরও অনেকে।