নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
দেশে সাইবার বুলিং এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণীরা সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিং এর শিকার হচ্ছেন বলে জানাগেছে। করোনাকালে এর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে পুলিশ জানিয়েছে।
ডিএমপির সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের তথ্য বলছে, এখন অনলাইনে সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা ঘটছে। ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ছয় মাসে সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে সাইবার অপরাধের শিকার ৮২৭ ভিকটিমকে সেবা দেয়া হয়। অনলাইনে সাহায্য করা হয় ৮ হাজার ৭৭০ জনকে।
সূত্র জানায়, রাজধানীর মিরপুরের একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় মাজেদুল হক মনি নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তার, যিনি ফেসবুকে ‘আনলিমিটেড ফান ফ্যাক্টরি’ নামে একটি গ্রুপ চালাতেন। এখানকার সদস্যরা তাদের প্রকৃত পরিচয় গোপন রেখে অন্যের পরিচয় ও ছবি ব্যবহার করতেন। মেয়েদের ‘উত্তেজক ছবি’ গ্রুপে পোস্ট করে ‘মজা করতেন’।
বিষয়টির প্রতিবাদ করায় সেই তরুণীকে নিয়েই ‘অশ্লীল আলোচনা’ শুরু করেন গ্রুপের সদস্যরা। কেউ কেউ তাকে গালাগাল করেন, তাকে ধর্ষণ করার হুমকিও দেন। একপর্যায়ে ওই তরুণী বিষয়টি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগকে জানান। পুলিশের এই বিশেষ শাখার তৎপরতায় হয়রানি থেকে মুক্তি পেয়েছেন ওই তরুণী।
সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ফেসবুকসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনেক মেয়েই এ ধরনের সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। প্রতিদিন অভিযোগ জমা পড়ছে তাদের কাছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেলিব্রেটি বা অভিনেত্রীরা পর্যন্ত স্ট্যাটাস দিতেও ভয় পান সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়ার আতঙ্কে।
সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সাইবার বুলিং এ সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা। অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ কথা বলে মানসিক ও সামাজিকভাবে কাউকে আঘাত করাই হলো সাইবার বুলিং। এ ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে নারীদের ক্ষেত্রে।
ওই তরুণীর সাইবার বুলিংয়ের ‘প্রতিকার হিসেবে’ অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা মাজেদুলকে ডেকে এনে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তার আগে আনলিমিটেড ফান ফ্যাক্টরি পেজেই মেয়েটির কাছে ক্ষমা চেয়ে স্ট্যাটাস দেন মাজেদুল। এরপর বিতর্কিত পেজটি বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের অসংখ্য পেজ ও গ্রুপ আছে, যেখানে প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন অনেকে, বিশেষ করে অল্প বয়সী মেয়েরা।
সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ বলেন, ‘বর্তমানে সাইবার জগতে যেসব অপরাধ হচ্ছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে সাইবার বুলিং। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পর্নোগ্রাফি-সংক্রান্ত অপরাধ।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনায় অনলাইননির্ভরতা বেড়েছে। এ সময়ে সাইবার স্পেসে নারীঘটিত মানহানি, রাজনৈতিক মানহানি ও ব্যক্তিগত আক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট মেসেঞ্জার বা এনক্রিপ্টেড অ্যাপের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও শেয়ার করার প্রবণতা বেড়েছে। আর এসব কনটেন্ট যখন কোনো অসাধু ব্যক্তির দখলে চলে যায়, তখনই ঘটে ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা। এভাবে করোনাকালে ব্ল্যাকমেইলের সংখ্যাও বাড়ছে।’
পুলিশ কর্মকর্তা ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ জানান, করোনা পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে কিছু অপরাধী নিয়মিত অন্যের রূপ ধারণ করে সাইবার স্পেসে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছে। এমনকি অনলাইনে কেনাবেচা করতে গিয়েও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকে।
পুলিশের সেন্ট্রাল ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে ডিএমপিসহ সারা দেশে সাইবার বুলিং-সংক্রান্ত ১ হাজার ১৬৫টি মামলা হয়। ২০১৯ সালে মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০৭-এ। ২০২০ সালে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪৫৯টি। করোনার কারণে চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় মামলা একটু কম হলেও অনলাইনে অভিযোগ পড়েছে অনেক বেশি। অফলাইনে অভিযোগ ৩৬ শতাংশ কমলেও অনলাইনে বেড়েছে ১৬ শতাংশ।
সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপকমিশনার (ডিসি) আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, ‘সাইবার বুলিং দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ বুলিংয়ের শিকার হলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। কোর্টে মামলা করতে পারেন। থানায় জিডি করতে পারেন। আমাদের কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে জানাতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বুলিংয়ের শিকার ব্যক্তির পক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার। যারা বুলিং করেন, তাদের বিরুদ্ধে শুধু আইন প্রয়োগ করলেই হবে না। তাদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ ধরনের অপরাধ মোকাবিলায় পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
‘কারণ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন নারী সহপাঠীকে ছেলেবন্ধুরা বুলিং করতে পারে, কোনো একটি শিশু তারই পরিচিত আরেক শিশুকে বুলিং করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে তো আইন প্রয়োগ করা যাবে না। শিশুদের বাবা-মাকে এসব বিষয়ে সংবেদনশীল হয়ে বুঝাতে হবে, এটি একটি অপরাধ। তাহলেই এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।’
তিনি জানান, ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন ছাড়াও পুলিশ সদর দপ্তরের ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামে আরেকটি টিম রয়েছে। এই টিমের সবাই নারী পুলিশ। অপরাধের শিকার নারীরা যাতে সহজে এবং ভয়ভীতিহীনভাবে অভিযোগ জানাতে ও প্রতিকার চাইতে পারেন, সে জন্য গত বছরের নভেম্বরে ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামে একটি অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ চালু করা হয়।
আ ফ ম আল কিবরিয়া আরও জানান, বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, পর্নোগ্রাফি কন্ট্রোল অ্যাক্ট, আইসিটি অ্যাক্ট, টেলি-কমিউনিকেশন অ্যাক্ট- এসব আইনে হওয়া মামলার অধিকাংশ ঘটনার ভিকটিম বা শিকার নারী।
পুলিশ সদর দপ্তরের আইনি আড়ি পাতা শাখার (এলআইসি) কর্মকর্তারা জানান, গত বছর ফেসবুক পেজটি চালু হওয়ার পর আট মাসে ১০ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে। তাদের হটলাইনে কল আসে প্রায় ১৬ হাজার। ই-মেইল আসে তিন শতাধিক। অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রায় পাঁচ হাজার অভিযোগের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সাইবার স্পেসে বুলিংয়ের শিকার ব্যক্তিরা কীভাবে আইনি সহায়তা পেতে পারেন, এমন প্রশ্নে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশনস) সোহেল রানা বলেন, ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন শাখার একটি ফেসবুক পেজ রয়েছে। এই পেজের ইনবক্সে সাইবার বুলিংয়ের শিকার নারীরা তাদের সমস্যার কথা লিখে পাঠান। সেটি পাওয়ার পর যাচাই-বাছাই করে আইনি সেবা দেয়া হয়ে থাকে। এ শাখার হটলাইন নম্বরে সরাসরি ফোন করেও প্রতিকার পান ভিকটিমরা। অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে।’