নড়াইল নিউজ ২৪.কম আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে যে হামলা হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সেটি প্রায় নিশ্চিত করেছিলেন বুধবার সন্ধ্যায়। গোয়েন্দাদের এই তথ্যের ভিত্তিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর আমেরিকান নাগরিকদের অবিলম্বে ওই এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়। এই সতর্কবার্তার পরপরই নিভে যায় ১৩ মার্কিন সৈন্যসহ ১৭০ জনের বেশি মানুষের প্রাণ।
তাদের এই সতর্কবার্তার মাত্র ১২ ঘণ্টার মাথায় একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বিপুলসংখ্যক মানুষের ভীড় পেরিয়ে কাবুলের বিমানবন্দরের একটি গেইটে পৌঁছায়; যেখানে মার্কিন সশস্ত্র সৈন্যরা নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গেইটে পৌঁছানো সেই হামলাকারী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেয়; নিভে যায় ১৩ মার্কিন সৈন্যসহ ১৭০ জনের বেশি মানুষের প্রাণ।
আফগানিস্তানে ২০ বছরের যুদ্ধের অবসানের শেষ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মর্মপীড়াদায়ক ক্ষত তৈরি করেছে এই ঘটনা। গত এক দশকে আফগানিস্তানে একদিনে যুক্তরাষ্ট্রের এতসংখ্যক সৈন্যের প্রাণহানি আর কখনোই ঘটেনি। দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহারের ঘোষণার দেওয়ার পর ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে সেখানে।
কাবুলের বিমানবন্দরের বাইরের বিস্ফোরণের এই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। তারা বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন— তালেবানের তল্লাশি চৌকি কীভাবে পেরিয়ে গেল আত্মঘাতী হামলাকারী? হামলা আসন্ন জেনেও কেন মার্কিন সৈন্যরা জনাকীর্ণ স্থানে অবস্থান করছিলেন? হাজার হাজার সৈন্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও হামলাকারী কেন ধরা পড়লো না?
হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল ফ্রাঙ্ক ম্যাককেঞ্জি বলেছেন, কোথাও না কোথাও ব্যর্থতা ছিল। পরে ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের আফগানিস্তানের স্থানীয় অনুসারী ইসলামিক স্টেট খোরাসান (আইএসআইএস-কে)।
কিন্তু বিমানবন্দরে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, এক পর্যায়ে সরিয়ে নেওয়ার কাজে নিয়োজিত বিমানের ফ্লাইটে চড়ার চেষ্টাকারী লোকজনের সংস্পর্শে আসা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না সৈন্যদের। সৈন্যরা তাদের তল্লাশি করে, শরীরে অস্ত্র অথবা বিমানে ওঠার পর তারা কোনও ধরনের হুমকি হতে পারে কিনা তা নিশ্চিত করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, হামলার পরিকল্পনা কয়েক মাস আগেই ঠিক করা হয়েছিল। তারা রয়টার্সকে বলেছেন, রাজধানীর দখল তালেবানের হাতে যাওয়ার পর কাবুল বিমানবন্দর থেকে লোকজনকে সরানোর কাজ শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেই মার্কিন সামরিক বাহিনী ঝুঁকিপূর্ণ আফগানদের সরিয়ে নেওয়ার অনুমতি চেয়েছিল।
কর্মকর্তাদের মতে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার ধীরগতি এবং সরিয়ে নেওয়া লোকজনের জন্য তৃতীয় কোনও দেশে আবাসনের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থতা সেটিকে আরও ধীর করে তোলে। এমনকি এক পর্যায়ে কাবুল থেকে সব ধরনের বিমানের চলাচল প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে বন্ধ রাখতে হয়। যে কারণে চরম বিশৃঙ্খলার মুখে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বিমানবন্দরের গেইটে সম্মুখসারিতে চলে আসেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এটার দরকার ছিল না। তাদের মারা যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না।’
কাবুল বিস্ফোরণে ২৫ পাউন্ডের বিস্ফোরক:
কাবুল বিমানবন্দরের বাইরের অ্যাবে গেইটের কাছে প্রথম আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণের পর তালেবানের সশস্ত্র সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছোড়েন। সন্ত্রাসী হামলার হুমকির কারণে সতর্কতা হিসেবে বন্ধ করে দেওয়া তিনটি গেইটের একটিতে আত্মঘাতী এই বোমা বিস্ফোরণের কথা যুক্তরাষ্ট্রও নিশ্চিত করে।
প্রথম বিস্ফোরণের পর বিমানবন্দরের কাছের ব্যারন হোটেলের উত্তর গেইটে দ্বিতীয় আত্মঘাতী বোমা হামলার কথা জানায় মার্কিন সামরিক বাহিনী। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক অপারেশনের জয়েন্ট স্টাফ ডেপুটি ডিরেক্টর মেজর জেনারেল হ্যাঙ্ক টেলর বলেন, দ্বিতীয় আত্মঘাতী বোমা হামলার তথ্যটি সঠিক নয়।
বিমানবন্দরের গেইটে যে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল আত্মঘাতী হামলাকারী; তার ওজন ছিল প্রায় ২৫ পাউন্ড। এত বিশাল ওজনের বিস্ফোরক কীভাবে বিমানবন্দরের গেইট পর্যন্ত ওই হামলাকারী নিয়ে গেলেন; সেটি নিয়ে রীতিমতো বিস্মিত মার্কিন সেনা কর্মকর্তারা।
বাগরাম ঘিরে বিতর্ক:
মার্কিন নাগরিক এবং আফগান সহযোগীদের বিপজ্জনকভাবে সরিয়ে নেওয়ায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি বাগরাম গত জুলাইয়ে হস্তান্তরে নেওয়া ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
রিপাবলিকান দলীয় কিছু আইনপ্রণেতার যুক্তি— বাগরাম ঘাঁটি চালু থাকলে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ আরও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করা যেতো। যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, বাগরামের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রায় ৮ হাজার সৈন্যের প্রয়োজন হতো। তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর হামলা হবে এটা সহজ অনুমেয় ছিল। কাবুল ছাড়তে চাওয়া আমেরিকানদের ৪০ মিনিটের পথে তালেবানের তল্লাশি চৌকির মুখোমুখি হতে হয়।
হামলার পর কাবুল বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৫ হাজার সৈন্যকে সরিয়ে নেওয়ার দিকেই এখন পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার হোয়াইট হাউস বলেছে, কাবুল বিমানবন্দরে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আগামী কয়েকদিন হবে সবচেয়ে বিপজ্জনক।
উদ্ধার অভিযান পরিচালনার সময় ইতোমধ্যে একটি বিমান লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিরা। কিন্তু তারা সফল হয়নি বলে জানিয়েছে মার্কিন কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রকেট হামলা এবং আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ আরও বেশি হুমকি হয়ে উঠবে বলে জানিয়েছেন তারা।
সামরিক সরঞ্জাম, সৈন্য এবং নিজ নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ অব্যাহত থাকলেও আফগান সহযোগীদের উদ্ধারের সংখ্যা দ্রুত কমতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, সৈন্যদের প্রত্যাহার কিছুটা চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। কারণ কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে মানবিক সংকটের পাশাপাশি নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি হয়েছে।
অতীতেও বিভিন্ন সময়ে সামরিক প্রত্যাহারের সময় এ ধরনের হামলার ঘটনা দেখা গেছে। ২০১১ সালে ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সময় সন্ত্রাসীরা একক লক্ষ্যে আঘাত হানার পরিকল্পনা করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রত্যাহারের মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোর পরিবর্তে তারা সরাসরি বিমানবন্দরকে টার্গেট করে।
সামরিক পরিকল্পনাবিদরাও এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে মরিয়া; যেখানে হাজার হাজার আফগান বিমানে চড়ার জন্য রানওয়েতে জড়ো হয়েছেন। দেশ ছাড়তে মরিয়া আফগানদের কয়েকজন বিমানের চাকায় চেপে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যদিও ভাগ্য তাদের সহায় ছিল না। চলন্ত বিমান থেকে আছড়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রতীকী প্রতিশোধ:
বৃহস্পতিবারের ওই হামলা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। তিনি বলে, বিমানবন্দরের হামলায় দায়ীদের খুঁজে বের করা হবে। হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে পেন্টাগনকে হামলার নির্দেশ দেন তিনি।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী বলেছে, আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে তারা ইসলামিক স্টেট খোরাসানের হামলার পরিকল্পনাকারীকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এতে কাবুলে হামলার মূল হোতা নিহত হয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা এই হামলাকে সতর্কভাবে প্রতীকী অথবা সীমিত অভিযানের বাইরে কিছু বলতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্র আসলে ইসলামিক স্টেট অব খোরাসানের বিরুদ্ধে তেমন কঠিন ব্যবস্থাই নিতে পারবে না।
মার্কিন ওই প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমরা ২০১৪ সাল থেকে আফগানিস্তানে এই গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এই গোষ্ঠীর হাজার হাজার সদস্য থাকায় সেই চেষ্টা সফল হয়নি।’