নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের করা ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ মামলার প্রাথমিক তদন্তে কমপক্ষে ৪৫০ কোটি টাকার গরমিল পাওয়া গেছে। তদন্তে ই-অরেঞ্জের দুটি ব্যাংক হিসাবকে গুরুত্ব দিচ্ছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। মলার প্রধান তিন আসামি ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান ও চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আমানউল্লাহ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান,মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
ইতোমধ্যে এই তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিন করে রিমান্ডের অনুমতি দিয়েছে আদালত। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আগে ব্যাংক দুটির স্টেটমেন্ট যাচাই করছি। সেগুলো বিশ্লেষণ করে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করব।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ই-অরেঞ্জের সিটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে ৬২০ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার ৭২৯ টাকা। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি হিসাবে জমা পড়ে ৩৯১ কোটি ৬৭ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৯ টাকা।
এই টাকার পুরোটাই গ্রাহকদের বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। অ্যাকাউন্ট দুটির স্টেটমেন্ট বলছে, জমা হওয়ার টাকা থেকে উত্তোলন করা ৬৫৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা গেছে চারটি বাইক বিক্রির প্রতিষ্ঠানে। এরা ই-অরেঞ্জের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ভেন্ডর। বাকি টাকা ই-অরেঞ্জের মালিকসহ নানান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন সময়ে তোলা হয়েছে।
ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকের হিসাব দুটির গত ছয় মাসের লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পণ্য সরবরাহকারী ভেন্ডরদের টাকা পরিশোধের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে একাধিক ব্যক্তির নামে বড় অঙ্কের টাকা তোলা হয়েছে। এ ছাড়া একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের ফান্ড ট্রান্সফার করা হয়েছে।
হাতে আসা নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভেন্ডরদের বিলের বাইরেও প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো নগদ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে ই-অরেঞ্জের হিসাব থেকে। গত জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে জুন পর্যন্ত সিটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে অদিতি নামের একজন নগদ টাকা তুলেছেন। অদিতি ই-অরেঞ্জের ব্র্যাক ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকেও কয়েক দফা টাকা তুলেছেন।
এ ছাড়া ফজলু, মিলন, সাইফুল, শেখ সোহেল রানা, জোবায়ের, বাবু, রিফাত, ইমরান নামের ব্যক্তিরা ধারাবাহিকভাবে চেকের মাধ্যমে টাকা তুলেছেন ওই দুটি অ্যাকাউন্ট থেকে। তাদের মধ্যে ফজলু ও মিলন প্রায়ই দিনে ৫০ লাখ করে টাকা করে তুলেছেন। ফজলু ই-অরেঞ্জের দুটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ১১ কোটি টাকা ও মিলন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা তুলেছেন। অদিতি তুলেছেন প্রায় তিন কোটি টাকা।
এর বাইরে অরেঞ্জ বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠানে গেছে প্রায় চার কোটি টাকা। শেখ সোহেল রানা তুলেছেন প্রায় আড়াই কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন নিজে তুলেছেন প্রায় তিন কোটি টাকা। বাকি টাকা ই-অরেঞ্জের নামে এবং বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নগদ উত্তোলন করা হয়। এ ছাড়া অ্যাকাউন্ট দুটি থেকে নিয়মিত আইএনডি সিএলজি ঢাকা স্পেশাল ও আইএনডি সিএলজি ঢাকা রেগুলারের দুটি অ্যাকাউন্টেও বড় ফান্ড পাঠানো হয়েছে।
এই টাকার বেশির ভাগই এপ্রিল থেকে ১৫ মে- এই দেড় মাসে তোলা হয়েছে। ১৫ মে থেকেই ই-অরেঞ্জের গ্রাহকদের পণ্য ডেলিভারি বন্ধ হয়ে যায়।
টাকা যারা তুললেন তারা কারা:
ই-অরেঞ্জের ট্রেড লাইসেন্সের নিবন্ধন অনুযায়ী, সোনিয়া মেহজাবিন প্রতিষ্ঠানটির মালিক। শেখ সোহেল রানা হলেন মেহজাবিনের ভাই। তিনি বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে দায়িত্বরত।
অদিতি ই-অরেঞ্জের অ্যাকাউন্টস অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রিফাত ও ইমরানও ই-অরেঞ্জে কাজ করতেন। তবে ই-অরেঞ্জ তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার কিছুদিন আগে অদিতি, রিফাত ও ইমরানকে প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে অরেঞ্জ বাংলাদেশ লিমিটেডে নিয়োগ দেয়ার তথ্য দিয়েছেন ই-অরেঞ্জের কয়েকজন কর্মচারী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, সোনিয়া মেহজাবিন ও শেখ সোহেল রানা দুজনকেই তারা মালিক হিসেবে জানতেন। তাদের দুজনের অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও রেড অরেঞ্জ নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান আছে। তবে এই তিনটি প্রতিষ্ঠান আলাদা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ফজলু, মিলনসহ অন্যরা অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও রেড অরেঞ্জের কর্মচারী হতে পারেন বলে ধারণা করছেন তারা।
ই-অরেঞ্জের ব্যাংক হিসাব দুটি পর্যালোচনা করছে গুলশান থানা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ই-অরেঞ্জের হিসাব থেকে যারা টাকা তুলেছেন, সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হবে। গ্রাহকদের টাকা বেআইনিভাবে যার কাছেই গেছে, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
অরেঞ্জ বাংলাদেশের ই-টিআইএন সার্টিফিকেটের একটি অনুলিপি পেয়েছে। সেখানে দেখা যায় ‘অথরাইজড পার্সন’ হিসেবে নাজমা সুলতানা পিয়ার নাম রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে নাম রয়েছে শেখ সোহেল রানার। জানা গেছে, নাজমা সুলতানা পিয়া সোহেল রানার সাবেক স্ত্রী। তারা দুজনে ২০১৪ সালে অরেঞ্জ বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন।
নেপথ্যে সোহেল রানা:
সোনিয়া মেহজাবিন কাগজে-কলমে ই-অরেঞ্জের মালিক হলেও তার ভাই শেখ সোহেল রানা আড়ালে থেকে সব ধরনের পরিচালনা করতেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রিমান্ডে থাকার সময় ই-অরেঞ্জের সাবেক সিওও নাজমুল আলম রাসেল এমন তথ্য দিয়েছেন।
রাসেলের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক মাসে সোহেল রানা ই-অরেঞ্জ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তার অরেঞ্জ বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যান। অরেঞ্জ বাংলাদেশের বিনিয়োগ রয়েছে বেশ কিছু ব্যবসায়িক খাতে।
গোয়েন্দা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শেখ সোহেল রানা আর তার বোন মেহজাবিন মিলে গ্রাহকদের টাকা অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনেছেন, বিদেশের কিছু টাকা গিয়েছে বলেও আমরা তথ্য পেয়েছি। এর সবকিছুই নিশ্চয়ই গুলশান থানার পুলিশ তদন্ত করে দেখবে।’
অভিযোগের বিষয়ে শেখ সোহেল রানার বক্তব্য জানার চেষ্টা করেছে। তবে একাধিকবার বনানী থানায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত ও অফিশিয়াল ফোন নম্বরে কল করা হলেও তিনি ধরেননি, খুদে বার্তারও সাড়া দেননি।