নড়াইল নিউজ ২৪.কম আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
দুই দশক পর আফগানিস্তান আবার কওমি মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠীটির নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর বেশ ফুরফুরে মেজাজে তারা। কাবুল তালেবানের নিয়ন্ত্রণে এসেছে রোববার। নব্বই দশকে যখন দেশটির প্রধান শহরের নিয়ন্ত্রক ছিল, সে সময় তারা যে কঠোরতা দেখিয়েছে, এবার সেটা দেখাবে না, বারবার এমন ঘোষণা আসছে। বহুজন বলাবলি করছেন, ‘এই তালেবান সেই তালেবান নয়’। তারা বুঝি এবার চমক দেখাবে। আর যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করতে অনীহা দেখানোয় কেউ বুঝি তালেবানকে কিছুই বলতে পারবে না।
দেশটির বিভিন্ন এলাকায় এরই মধ্যে বিক্ষোভ শুরু করেছে সাধারণ জনতা। সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তারা সংগঠনটির পতাকা নামিয়ে জাতীয় পতাকা তুলছেন। তালেবানের কাছে নতি স্বীকার না করা এক প্রখ্যাত যোদ্ধার ছেলে চেয়েছেন অস্ত্র সহায়তা। জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণে ত্যক্ত বিরক্ত অনেকেই তার দলে।
কিন্তু ঘটনা নিচ্ছে অন্য মোড়। সাধারণ জনতার প্রতিরোধের মুখেই যে তালেবান পড়তে যাচ্ছে, সে ইঙ্গিত স্পষ্ট। এরই মধ্যে অস্ত্র চেয়ে আহ্বান জানানো হয়েছে বহুল পরিচিত এক প্রয়াত যোদ্ধার ছেলের পক্ষ থেকে।
আবার পালিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির ডেপুটি, অর্থাৎ ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ অজ্ঞাত স্থান থেকে এক বার্তায় দিয়েছেন প্রতিরোধের ডাক। বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পালিয়ে যাওয়ায় তিনিই এখন প্রেসিডেন্ট।
তার এই ঘোষণার দৃশ্যত বড় কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু একেবারেই কি নেই, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে।
সালেহ অজ্ঞাত স্থান থেকে বার্তা দিয়েছেন সোমবার। আর বুধবারই তালেবানবিরোধী বিক্ষোভ দেখা গেছে দেশটির জালালাবাদ শহরে।
এই শহরটিও যুদ্ধ ছাড়া তুলে দেয়া হয়েছিল। আর সেই শহরের বাসিন্দারাই তালেবানের তোলা পতাকা নামিয়ে নিজের দেশের পতাকা উড়িয়েছেন।
বিরোধিতা যে তালেবান একদম সহ্য করবে না, তা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয় তাদের যোদ্ধারা। সোজা বুক বরাবর গুলিতে প্রাণ যায় তিন জনের, আহত হয় আরও বহু।
ঘটনা এই একটি নয়। বৃহস্পতিবার দেশটির স্বাধীনতা দিবসেও দেখা গেল একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
বৃহস্পতিবার জালালাবাদের আসাদাবাদ ছাড়াও বিক্ষোভ হয়েছে অন্তত ৫টি শহরে। বাদ যায়নি রাজধানী কাবুলও। এখানেও তালেবানের সরাসরি গুলি। আর্তনাদ, প্রাণহানি।
বিক্ষোভকারীরা তালেবানের পতাকা নামিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, আগামীতে জনপ্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে ‘বিজয়ী’ তালেবানদের।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে খোস্ত প্রদেশে কারফিউ জারি করেছে সতর্ক তালেবান। মধ্যরাত থেকে এই কারফিউ দেয়া হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। সড়কে দেখা গেছে তালেবান সশস্ত্র যোদ্ধা ও তাদের সাঁজোয়া যানের সরব অবস্থান।
এর মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও কার্যালয়ে দেশটির জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
রোববার তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর দেশ ছেড়ে ভাগতে মরিয়া চেষ্টা করেছিল আফগানবাসী। মালবাহী বিমানে পণ্য হয়ে চড়ে জীবন বাঁচাতে চেয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। ভেতরে জায়গা না পেয়ে নিজেকে চাকার সঙ্গে বেঁধেছিলেন দুই জন। ভেবেছিলেন এভাবেই উড়ে যাওয়া যাবে কোথাও, যেখানে কট্টর শাসনে থাকতে হবে না।
কিন্তু সেটি হওয়ার ছিল না। আকাশ থেকে সেই বাঁধন ছিঁড়ে দুই জন পড়েছেন মাটিতে। কট্টর ধর্মীয় শাসন থেকে বাঁচার সাধ আর পূরণ হলো না।
তবে এখন আর পালানোর সুযোগ নেই। তাই বিদ্রোহেই নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনগণ।
গত কয়েকদিন তালেবানবিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করে জনতা।
দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল প্রদেশ জালালাবাদের আসাদাবাদে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় বিক্ষোভের শুরু। জাতীয় পতাকা উড়িয়ে মিছিল করছিল বিভিন্ন বয়সী হাজারো আফগান নাগরিক। তারা দেশটির সরকারি ভবনগুলোতে তালেবানের পতাকা সরিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দাবি জানান।
সড়কে লোডেড গান নিয়ে থাকা তালেবান যোদ্ধারা এই বিক্ষোভ সহ্য করেনি। সরাসরি গুলি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে কাবুলেও। শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর জাতীয় পতাকা নামিয়ে নিজেদের পতাকা তুলেছিল তালেবান। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় এতদিন উড়ছিল সেই পতাকাই।
১০২ বছর আগে স্বাধীনতা পাওয়ার দিনটিতে এই অবস্থা দেখে নিজেদের পরাধীন ভাবছিল সাধারণ মানুষ। তারা বিভিন্ন স্থানে তিন রঙের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু করে। তারা তালেবানদের দুই রঙের পতাকা বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনা থেকে সরিয়েও ফেলে।
সড়কের পাশে সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধাদের উপস্থিতি ও তাদের সাঁজোয়া যানের ভীতিকে উপেক্ষা করে সাধারণ আফগান নাগরিকরা তালেবানবিরোধী স্লোগান দেয়। এ সময় তারা দেশটির জাতীয় পতাকা ও ‘আফগানিস্তান চিরঞ্জীব হোক’ বলে স্লোগান দেয়।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের পাশাপাশি তালেবানের ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ হয়েছে দেশটির বিভিন্ন স্থানে।
তালেবান হটাতে অস্ত্র চায় যোদ্ধারা:
৯০ দশকে তালেবানের বিরুদ্ধে কাবুলের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পঞ্জশিরে প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া আহমেদ শাহ মাসুদ ২০০১ সালে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘পঞ্জশিরের সিংহ’ নামে।
তার ছেলে আহমেদ মাসুদ এবার ডাক দিয়েছেন তালেবানকে ঠেকানোর। তিনি তার মিলিশিয়া বাহিনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র সহায়তাও চেয়েছেন।
স্থানীয় সময় বুধবার ওয়াশিংটন পোস্টের মতামতে মাসুদ এসব বার্তা দেন বলে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
মাসুদ বলেন, ‘আমি আজ পঞ্জশির ভ্যালি থেকে লিখছি। আমার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে আমি প্রস্তুত। মুজাহিদীনরা তালেবানের ওপর ফের আঘাত হানতে তৎপর।’
হিন্দুকুশ পর্বতমালার মাঝে অবস্থিত পঞ্জশির কখনো তালেবানের হাতে পড়েনি। শুধু তাই নয়, আশির দশকে পঞ্জশির দখলে ব্যর্থ হয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনীও।
তালেবান আফগানিস্তানের বড় অংশ গত কয়েক সপ্তাহে দখলে নিতে সমর্থ হলেও এখন পর্যন্ত পঞ্জশিরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি।
মাসুদ বলেন, ‘আফগানিস্তানের বিশেষ বাহিনীর সাবেক সদস্য এবং কমান্ডারদের আত্মসমর্পণে বিরক্ত আফগান সেনারা এরই মধ্যে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।’
আফগানিস্তানের অর্থ আটকে দিল যুক্তরাষ্ট্র:
কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠী তালেবানের হাতে যাওয়ার আশঙ্কায় নিজেদের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা থাকা আফগানিস্তানের বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বুধবার ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, বাইডেন প্রশাসনের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে আলোচনায়ও বসতে যাচ্ছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আফগানিস্তান ছাড়েনি যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা:
রোববার তালেবান কাবুল দখলের পরপরই আফগানিস্তান থেকে দ্রুত নাগরিকদের দেশে ফেরাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও প্রায় ১৫ হাজার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অবস্থান করছে।
আফগানিস্তান ছাড়তে মরিয়া লোকজনকে কাবুল বিমানবন্দর পৌঁছতে তালেবান বাধা দেয়ায় নির্ধারিত সময়সীমার পরও দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা অবস্থান করতে পারে। এবিসি নিউজকে স্থানীয় সময় বুধবার দেয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এসব বার্তা দেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।