নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
আজ মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) দিনাজপুরে ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির ২৬ বছর পূর্ণ হল । ১৯৯৫ সালের এ দিনে কিছু পুলিশ সদস্যের ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন ১৮ বছরের তরুণী ইয়াসমিন। ওই ঘটনার পর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের মানুষ। সেই বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন সাতজন। আহতের সংখ্যা ছিল তিন শতাধিক।
এরপর থেকে দিনটিকে সারা দেশে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। তবে দিনাজপুরে তা পালিত হয় ‘ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস’ হিসেবে।
সেই ঘটনার ২৬ বছর পার হলেও দেশে এখনও বন্ধ হয়নি নারী নির্যাতন। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা কর্মীদের ভাষ্য, এখনও নানাভাবে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সঠিকভাবে বিচার না হওয়া এবং আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সহজে বেঁচে যাওয়ায় এ ধরনের নির্যাতন বেড়েই চলেছে।
এ ছাড়া জনতার প্রতিবাদে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিচার হলেও সেই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গুলি ও টিয়ার শেলে আহতদের খোঁজ কেউ রাখেননি।
আহতদের আক্ষেপ, বিভিন্ন সময় তাদের সহায়তার আশ্বাস দেয়া হলেও তারা কিছু পাননি। বছর ঘুরে দিবসটি এলে অনেকে তাদের সহায়তার আশ্বাস দেন। তবে দিবস গেলে তাদের খোঁজ কেউ করেন না।
প্রতিবছরই নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিনাজপুর দশমাইলের সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে ইয়াসমিন স্মৃতি পরিষদ। এ ছাড়া ইয়াসমিনের কবর জিয়ারত ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
ইয়াসমিনের মা শরীফা বেগম দোয়া অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নিজবাড়িতে দুস্থদের মাঝে বিতরণ করবেন খাবার।
ছবি সংগৃহীত
ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা যেভাবে:
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ভোরে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী হাছনা এন্টারপ্রাইজের নৈশ কোচের সুপারভাইজার ইয়াসমিনকে নামিয়ে দিয়েছিলেন দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ে। সেখানে এক চায়ের দোকানদারকে সকালে তাকে দিনাজপুর শহরগামী বাসে উঠিয়ে দিতে বলেছিলেন তিনি।
ইয়াসমিনকে নামিয়ে দেয়ার কিছুক্ষণ পরই সেখানে পৌঁছায় পুলিশের রাতের টহলের একটি পিকআপ ভ্যান। পুলিশ সদস্যরা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে থাকা ইয়াসমিনকে নানা প্রশ্ন করে এক পর্যায়ে তাকে শহরে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে তাদের ভ্যানে তুলে নেন।
এরপর দশমাইল এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে দিনাজপুর শহরের রানীগঞ্জ মোড়ে ব্র্যাক অফিসের সামনে রাস্তায় মরদেহ ফেলে রেখে যায় তারা।
ওই ঘটনার পর দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নামেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে দোষীদের শাস্তির দাবি জানানো হয়। ২৬ আগস্ট রাতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী কোতোয়ালি থানা ঘেরাও করে।
২৭ আগস্ট সকালেই প্রতিবাদী মানুষ শহরে বের করে বিক্ষোভ মিছিল। দুপুর ১২টার দিকে কয়েক হাজার মানুষের বিক্ষোভ মিছিল জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিতে যায়।
সেই মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে সামু, কাদের, সিরাজসহ সাতজনকে হত্যা করে। আহত হয় তিন শতাধিক। এরপর শহরের আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শহরে ১৪৪ ধারা (কারফিউ) জারি করা হয়। শহরে নামানো হয় তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। একযোগে প্রত্যাহার করা হয় দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ ১৩ উপজেলার সব পুলিশ সদস্যকে।
ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনায় হওয়া তিন মামলার রায় ঘোষণা হয় দুই বছর পর। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন এ রায় ঘোষণা করেন।
মামলার আসামি পুলিশের এএসআই মইনুল হক, কনস্টেবল আবদুস সাত্তার ও পুলিশের পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় রায়ে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগে এএসআই মঈনুলকে আরও পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।
চাঞ্চল্যকর এ হত্যায় দণ্ডপ্রাপ্তদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয় আট বছর পর। ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর এএসআই মইনুল হক ও কনস্টেবল আবদুস সাত্তারকে রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণের রায় কার্যকর হয়।
কেউ খোঁজ রাখেনি আহতদের:
ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির বিচার দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলি ও টিয়ার শেলের আঘাতে সাতজন নিহতের পাশাপাশি আহত হয়েছিলেন তিন শতাধিক মানুষ। তবে তাদের খোঁজ রাখেননি কেউ।
ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার মাসুদ রানা জানান, ২৭ আগস্ট কয়েক হাজার মানুষের বিক্ষোভ মিছিলটি জেলা কারাগারের সামনে পৌঁছালে পুলিশ লিলিমোড় থেকে অতর্কিত গুলি ছোড়ে। ওই সময় তিনি জেল রোডের মোটরসাইকেলের দোকানে মেরামতের কাজ করছিলেন। পুলিশের একটি গুলি তার বাঁ কানের কাছে লাগে।
পরে আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার সময় পৌরসভার সামনে থেকে আরেক দল পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল ছোড়ে। টিয়ার শেলের গ্যাসে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘পুলিশের গুলি ও টিয়াল শেলের আঘাতে আহত হয়ে আমি প্রায় ৯ মাস হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহায়তা পাই নাই।
ছবি সংগৃহীত
‘আমি বর্তমানে বাহাদুর বাজারে একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করি। ঠিকমতো কাজও করতে পারি না। হামলায় আহত হলাম, অথচ আজ পর্যন্ত আমার কেউ খোঁজ নিল না।’
মাসুদ আরও বলেন, ‘শুধু আমিই না, আমার মতো বহুজন আহত হয়ে খুব কষ্টে দিনযাপন করছে। বছর ঘুরে আসে, নেতারা দিবস উপলক্ষে ভাষণ দেন, কিন্তু আমাদের ব্যাপারে কেউ চিন্তা করে না।’
থামেনি নারী নির্যাতন:
দিনাজপুর মহিলা পরিষদের সভাপতি কানিজ রহমান বলেন, ‘আজ সারা দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হলেও দিনাজপুরে পালিত হচ্ছে ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস। ওই ঘটনার ২৬ বছর পার হলেও সমাজে এখনও নারীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
‘মূলত আইনের সঠিক প্রয়োগ ও আইনের বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে দ্রুত জামিনে বের হয়ে যাওয়ায় নারীর প্রতি নির্যাতন বেড়েছে। নারী নির্যাতনকারীদের দ্রুত বিচার হলে এটি অনেকটা কমে যাবে বলে আমি মনে করি।’
ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যা বিচারের দাবিতে আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল।
তিনি বলেন, ‘ইয়াসমিন হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনায় যে আন্দোলন হয়েছিল তা পুরো দিনাজপুরবাসীর অবদান। যখন দিনাজপুরে তীব্রতর আন্দোলন চলছিল, সব অচল হয়ে পড়েছিল, ঠিক সেই সময় আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনাজপুর এসেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘মূলত আন্দোলনটি ছিল নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ আন্দোলনের একটি মাইলফলক। আন্দোলনটি দিনাজপুরবাসীর সম্মান, মর্যাদা রক্ষার একটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছিল।’