নড়াইল নিউজ ২৪.কম ডেস্ক:
ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আসিফের বুকে প্রচণ্ড ব্যথা দেখা দিলে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য তাকে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওই ক্লিনিক থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হয়। গত ১০ দিন এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আসিফ। ইসিজি ও এনজিওগ্রামসহ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছেন, আসিফ হৃদরোগে আক্রান্ত।রাজধানীর ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করতেন আসিফ।
আসিফের মা আছিয়া বেগম বলেন, ছেলে কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে না। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে তাদের বুক কেঁপে উঠছে। এত অল্প বয়সে কেন এই রোগে আক্রান্ত হবে ছেলে?
সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের কাছে আসা হৃদরোগে আক্রান্তদের ২০ শতাংশই তরুণ। এই রোগের চিকিৎসায় গড়ে ওঠা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সেবা নেয়া রোগীর পরিসংখ্যানেও তাদের এ পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন মেলে। পরিসংখ্যান বলছে, এই হাসপাতালে ১০ বছর আগে চিকিৎসা নেয়া মোট রোগীর ৫ শতাংশ ছিল তরুণ। এখন সেটি বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলছেন চিকিৎসকরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতিবছর হৃদরোগে অন্তত ১ কোটি ৭৯ লাখ লোক মারা যায়। এর ৮০ শতাংশই মারা যায় হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে ১ লাখ ১২ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে হৃদরোগে।
বর্তমানে দেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ ভাগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগে। এর ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ হৃদরোগী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অংসক্রামক রোগের অন্যতম হৃদরোগ। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৯৭ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে হৃদরোগের ঝুঁকিতে।
হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, ১০ বছর আগে যুবকদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার ৫ শতাংশের নিচে ছিল। বর্তমানে তা ২০ শতাংশ পৌঁছেছে। বিশেষ করে জাংক ফুড ও মাদকে যাদের আসক্তি, তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আগে ৩০ বছরের নিচে হৃদরোগের রোগী পাওয়া যেত না, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এটি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। সংশ্লিষ্টদের এখনই গুরুত্ব দেয়া উচিত। এখনই সচেতন করা না গেলে সামনের দিনগুলোতে যুবকদের একটা অংশকে হারাব আমরা।’
প্রদীপ কুমার বলেন, করোনার উচ্চ সংক্রমণের সময়ে অনেক হৃদরোগের রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তারা হাসপাতালে আসতে পারেননি। তবে সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নিচে আসতে থাকলে ক্রমেই রোগীর চাপ বাড়তে থাকে। হৃদরোগের চিকিৎসায় এ হাসপাতালকে ৪১৪ শয্যা থেকে ১২শ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে।
এই হাসপাতালের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে হৃদরোগের প্রকোপ অনেক বেশি। দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় এই রোগে। দেশে হৃদরোগের রোগীদের ঝুঁকি অনেক বেশি হওয়াই প্রধান কারণ তামাকের ব্যবহার, হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়া, লবণ বেশি খাওয়া এবং ওজন বেড়ে যাওয়া। তিনি বলেন, ‘এসব কারণে আমাদের দেশে এখন কম বয়সিরা আক্রান্ত হচ্ছেন। একটা ছেলে ১৬ বছর বয়সে সিগারেট খাওয়া শুরু করলে ৪০ বছরে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।’
বঞ্চিত প্রান্তিক রোগীরা:
দেশে হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের উন্নত চিকিৎসা রাজধানীকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রয়োজনীয় সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক এলাকার রোগীরা। হাতে গোনা কয়েকটি বিভাগীয় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া জেলা-উপজেলায় রোগটির উন্নত সেবা মিলছে না। অন্য দিকে রোগটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতাও কম।
জানতে চাইলে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশের এপিডেমোলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘দেশে কয়েক বছর ধরে হৃদরোগের চিকিৎসাসেবার কলেবর বৃদ্ধি শুরু হয়েছে। বর্তমানে রোগটির উন্নত সেবা দেশেই মিলছে। তবে তা অনেকটা শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় আধুনিক সেবার প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও প্রান্তিক পর্যায়ের রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। তা ছাড়া, হৃদরোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অসচেতনতা ও চিকিৎসাকেন্দ্র ভেদে রোগটির সেবা ক্রয়মূল্য কম-বেশি হওয়ায় চিকিৎসা আওতার বাইরে থাকছেন অসংখ্য রোগী।’
যে কারণে বাড়ছে হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা:
দেশের বেশির ভাগ মানুষ তামাকের ব্যবহার, অতিরিক্ত চর্বিজাতীয়, তৈলাক্ত ও কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাদ্য বেশি পরিমাণে গ্রহণ করছেন। মানুষের কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়াসহ জীবনাচরণেও পরিবর্তন এসেছে। এতে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ তৈরি হচ্ছে। ফলে হৃদরোগ বাড়ছে।
অন্যদিকে রাজধানীকেন্দ্রিক উন্নত চিকিৎসা থাকলেও প্রান্তিক পর্যায়ে এই রোগের অপ্রতুল সেবা ব্যবস্থাসহ ওষুধের প্রাপ্যতাও কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, তামাকজাত পণ্য সেবন, কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়ায় দিন দিন মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বি জমা ও স্থূলতাজনিত কারণে হৃদরোগ ঝুঁকি বাড়ছে।